মেয়র নগরবাসীকে জরিমানা করে, মেয়রকে জরিমানা করবে কে?

ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি
আর মাত্র কিছুদিন, তারপরই নতুন ভাই কিংবা বোন আসছে। এ নিয়ে ভীষণ উচ্ছ্বসিত ছিল ১১ বছরের সায়মা। কিন্তু তার সেই উচ্ছ্বাস পরিণত হয়েছে বিষাদে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট সকালে মারা গেছেন সায়মার মা—৮ মাসের সন্তানসম্ভবা ফারজানা। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

'নগরবাসী সচেতন না' কিংবা 'নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে'—রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঘিরে এ ধরনের মন্তব্য শোনা গেছে উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামের কাছ থেকে। মশানিধনে ডিএনসিসি মানুষের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে, এডিসের লার্ভা পেলে জরিমানাও করা হচ্ছে।

আজ শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে 'কেন এই ডেঙ্গু মহামারি? পরিত্রাণ কোন পথে?' শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের কয়েকজন শীর্ষ কীটতত্ত্ববিদ মন্তব্য করেছেন, ডেঙ্গু তথা মশা নিয়ন্ত্রণের নামে দেশে তামাশা চলছে।

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ও কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'ব্যাঙ, হরিণ আর হাঁস দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটা দেখা যায় না।'

সিটি করপোরেশন তাদের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা খুঁড়ে রেখেছে। সেখানেও পানি জমে থাকে, সেখান থেকেও ডেঙ্গুঝুঁকি বাড়ছে।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে—সিটি করপোরেশন নিজে যখন এ ধরনের কাজ করে, তখন এর দায় কার? কিংবা খুঁড়ে রাখা রাস্তায় জমে থাকা পানিতে মশা বংশবিস্তার করলে কাকে জরিমানা করা হবে?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে।

তাদের ভাষ্য, জনগণের দায়বদ্ধতা আছে, কিন্তু জনসচেতনতা তৈরির দায়িত্ব সরকারের। এ ছাড়া, পাবলিক প্লেস পরিচ্ছন্ন রাখা ও মশানিধনের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।

আকতার মাহমুদ বলেন, 'আমাদের যে সুনাগরিক হওয়ার ব্যাপার আছে, এ কথাটা সঠিক। আমরা ভালো নাগরিকের আচরণ করি না। আমরা নিজস্ব সম্পদের ভেতরে এবং এর আশপাশে নানা জায়গায়, যেমন: কনস্ট্রাকশন সাইট, আন্ডারগ্রাউন্ড, পার্কিং, ছাদ—এমন অবস্থা করে রাখি, যেখান থেকে ডেঙ্গু মশার জন্ম হতে পারে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও আমরা ভালো কিছুর পরিচয় দেই না। যেখানে-সেখানে ডাবের খোসা, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ময়লা ফেলে রাখি। সেখানে ডিএনসিসি জরিমানা করছে।'

'তবে, নাগরিককে সুনাগরিক হিসেবে তৈরিতেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা আছে। মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছানো, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন মালিক সমিতির মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষকে উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনসচেতনতা তৈরির মতো কাজগুলো করতে হবে।'

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, 'নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পদের বাইরে থাকা রাস্তা-ঘাট, খাল-বিল, বিভিন্ন জায়গায় কনস্ট্রাকশন সাইট—সেগুলো তো সরকারি জায়গা। এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও দায়বদ্ধতা আছে। সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে জনগণ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ অংশগ্রহণ প্রয়োজন।'

'তবে এখানে প্রধান ভূমিকা সরকারি অফিসগুলোর, যেখানে কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সিটি করপোরেশন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসকে কখনোই তেমন সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায় না। কাজগুলোকে যদি শুধু মেয়র অফিসকেন্দ্রিক করে ফেলা হয়, তাহলে সাফল্য আসে না', যোগ করেন তিনি।

আকতার মাহমুদের মতে, এসব কাজে সফল হতে হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস ও স্থানীয় মানুষকে অনেক বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে।

শুধু অভিজাত এলাকাকে প্রাধান্য না দিয়ে সবজায়গাকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের মেয়র অফিসগুলো বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অভিজাত এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে সক্রিয় উদ্যোগ দেখা যায়, বাকি ওয়ার্ডগুলোতে ততটা দেখা যায় না।'

সিটি করপোরেশনের জরিমানা করার এখতিয়ারই নেই উল্লেখ করে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'জনগণের ওপর দায় দিয়ে মন্তব্যও তারা করতে পারে না। নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পেরে তারা অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করে।'

'তারা তো "মশা কমে গেলে ডেঙ্গু কমে যাবে, ডেঙ্গু কমে গেলে রোগী সেরে যাবে"—এমন সব থিউরি দিচ্ছেন, যা খুবই হাস্যকর। এত অযোগ্য মানুষ এ পদগুলোতে কাজ করছেন, তাদের কাছ থেকে এর বেশি আর কিছু আশা করা যায় না। এসব পদে বসে যখন তারা এ ধরনের মন্তব্য করতে থাকেন বা জরিমানা করেন, এগুলো তো খুবই অশোভন চর্চা। সাধারণ মানুষকে সঠিক পথে চালিত না করে উল্টো তাদের ওপরেই দোষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে ভোগান্তি তৈরি করছে, সেখানেও যে পানি জমায় ডেঙ্গুঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সেটার দায় তো তাদের', যোগ করেন তিনি।

কিছু ক্ষেত্রে শুধু সিটি করপোরেশনকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা ঠিক না বলেও মনে করেন এই আইনজীবী।

তার ভাষ্য, 'ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনার জন্য যতদূর মনে পড়ছে ৫৬টি অথরিটি আছে। একটা প্রতিষ্ঠান খোঁড়াখুঁড়ি করে চলে যায়, সেটা তারা ঠিক করে না। যাদের ঠিক করার দায়িত্ব, তাদের বাধ্য না করা পর্যন্ত কাজটি করে না। আবার বাধ্য করতে গেলে তারা বলে, আমাদেরকে তো আনুষ্ঠানিকভাবে নোটিশ দেয়নি। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ির আগে সব অনুমতি নিয়েই কাজ করে।'

শহর ব্যবস্থাপনায় এত বেশি প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত নয় উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'এই দায়িত্ব ন্যূনতম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর না দেওয়া হলে ১০০ বছর পারেও দেখবেন দোষারোপের সংস্কৃতিটাই রয়ে গেছে।'

মশানিধনের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কোনোভাবেই সিটি করপোরেশন তাদের দায় এড়াতে পারে না। বরং সাধারণ নাগরিকের ঘরে ঘরে গিয়ে জরিমানা করার অর্থ নিজেদের দায় জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা। আমাদের নিজেদেরও সচেতনতার ব্যাপার রয়েছে। কিন্তু পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে হোল্ডিংয়ে জন্য থাকার জন্য অর্থ পরিশোধ যেহেতু করতে হয়, সবকিছুই তো পেইড সার্ভিস। যাকে আমি সার্ভিসের জন্য টাকা দিচ্ছি, তার কাছ থেকে সার্ভিস না পেলে নিশ্চই কথা বলার সুযোগ থাকে।'

Comments

The Daily Star  | English

Khulna JP office vandalised

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna’s Dakbangla area yesterday evening.

3h ago