সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম: যার নেতৃত্বে হয়েছিল অপারেশন কিলোফ্লাইট

অপারেশন কিলোফ্লাইটের সদস্যদের সঙ্গে সুলতান মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

এক বর্ণিল কর্মময় জীবন ছিল তার। কর্মজীবনে তিনি কখনো দায়িত্ব পালন করেছেন বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে, কখনো রাষ্ট্রদূত হিসেবে। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগকেই জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তিনি যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতেন তখন তার চোখেমুখে ভীষণ আবেগ ভর করত। বলতেন, 'এদেশ তো আর পাঁচ দশটা দেশের মতো স্বাধীন হয়নি। লাখো শহীদের রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে নির্মিত হয়েছে আমাদের দেশ। বিশ্বের অন্য সব দেশের নাগরিকদের তুলনায় তাই আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধও বেশি থাকা উচিত। নয়তো আমরা শহীদদের আত্মার প্রতি, স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাতে ব্যর্থ হব।'

মুক্তিযুদ্ধের আগে ছিল তার স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন। তখন তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে স্কোয়াড্রন লিডার পদে কর্মরত। দুর্দান্ত মেধাবী এক বৈমানিক ছিলেন সুলতান মাহমুদ। চাইলেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিয়ে নির্ঞ্ঝাট জীবনকেই বেছে নিতে পারতেন। সামরিক বাহিনীর আলিশান জীবনযাপন ছিল। ফেনীর ছাগলনাইয়ার নানা বাড়িতে জন্মগ্রহন করলেও সুলতান মাহমুদের শৈশব এবং কৈশোরের পুরোটা সময়ই কেটেছে পাকিস্তানে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর হওয়ার পর আয়েশি জীবন তার  যাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের মে মাসে বিমানে চেপে শ্রীলংকায় চলে যান সুলতান মাহমুদ। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান। শ্রীলঙ্কা থেকে শেষমেশ ঢাকা আসেন তিনি। ঢাকা শহরে কয়েকদিন থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। কিন্তু সে পথটিও ছিল ভীষণ বিপদ সংকুল। পথে পথে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার ভয়। 

ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দাউদকান্দি ফেরি ঘাটের কাছে এসে যখন তিনি পৌঁছালেন, হঠাৎ দেখলেন তার পাশে এতক্ষণ বসে থাকা দুজন লোক আচমকা নেমে গিয়ে ফেরিঘাটের পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানি হানাদারদের তাবুর দিকে এগোচ্ছে। সুলতান মাহমুদ মুহূর্তের মাঝেই বুঝতে পারলেন তিনি ঘোর বিপদের মুখোমুখি। মুহূর্তেই কোনো কিছু না ভেবেই উত্তাল মেঘনা নদীতে ঝাঁপ দিলেন সুলতান মাহমুদ। স্রোতের টানই তাকে নিয়ে গেল। সুলতান মাহমুদের পাশে বসা এই দুজন ব্যক্তি আসলে ছিল পাকিস্তানি সেনা। যারা আসলে সিভিল পোশাকে পর্যবেক্ষণ করছিল। এভাবেই পথে পথে বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে পৌঁছেছিলেন সুলতান মাহমুদ।

প্রথমদিকে সুলতান মাহমুদকে ২ নম্বর সেক্টরের স্থল যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল। সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের একপর্যায়ে তাকে ১ নম্বর সেক্টরে পাঠানো হয়। গেরিলা কমান্ডার হিসেবে ১ নম্বর সেক্টরের রামগড় থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। তার নেতৃত্বে সংঘটিত একটি বড় অপারেশন ছিল চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের পাশের মদুনাঘাট বৈদ্যুতিক সাব স্টেশনে অপারেশন। 

আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মুক্তিবাহিনীর উচ্চপর্যায় থেকে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী ইস্টার্ন রিফাইনারি ধ্বংসের জন্য ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডারকে বলা হয়। 

কারণ ইস্টার্ন রিফাইনারি যেহেতু দেশের একমাত্র তেলশোধনাগার তাই এটি ধ্বংস করলে হানাদারদের জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস হলে চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ সরবরাহ ভেঙে পড়বে। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, এতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও ভীষণ ক্ষতি হবে। তাই বিকল্প দুটি পরিকল্পনা করা হয়। একটি মদনঘাটে বিদ্যুৎ বিভাগের সাব স্টেশন ধ্বংস করা অন্যটি কাপ্তাই ও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করা। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে। 

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সুলতান মাহমুদ ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিয়মিত সেনাকে বাছাই করে হরিণা থেকে রামগড় হয়ে রাউজানের বড়ুয়াপাড়া স্কুলে এসে ক্যাম্প স্থাপন করেন। বড়ুয়াপাড়া থেকে সাবস্টেশনের দূরত্ব ছিল ২ কিলোমিটারের মতো। মদনঘাটের বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনের চারপাশ ছিল উঁচু দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তায় ছিল ১ প্লাটুন হানাদার সেনা।

রেকিতে মুক্তিযোদ্ধারা বুঝলেন ভাটার সময়েই অপারেশন সহজ হবে। ৩ অক্টোবর রাত ২টায় সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ফায়ারের মধ্য দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। আক্রমণের একপর্যায়ে সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রকেট লঞ্চার দিয়ে দুটি ট্রান্সফরমার ধ্বংস করেন। এসময় বাঙ্কার থেকে ছোঁড়া হানাদার সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান গুরুতর আহত ও পরে শহীদ হন। অন্যদিকে ডান হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন সুলতান মাহমুদ। পরবর্তীতে সুলতান মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো স্থলযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অধ্যায়গুলোর একটি ছিল অপারেশন কিলোফ্লাইট। মুক্তিযুদ্ধের মে মাস থেকেই মূলত বাংলাদেশ সরকার বুঝতে পারে হানাদারদের উপর বিমান আক্রমণ ছাড়া পুরোপুরি সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। পরবর্তীতে ভারত সরকার ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর সঙ্গে নানা আলোচনা, বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ২৮ সেপ্টেম্বর নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত একটি এয়ারফিল্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এসময় বিমানবাহিনীর সম্বল বলতে ছিল তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফট। এগুলো ছিল যথাক্রমে যোধপুরের মহারাজার উপহারের একটি ডাকোটা ডিসি-৩ পরিবহন বিমান, ডি.এইচ.সি-৩ টুইন অটার পর্যবেক্ষণ বিমান ও ওষধ নিক্ষেপের কাজে ব্যবহৃত একটি অ্যালুয়েট থ্রি হেলিকপ্টার। এই তিনটি বিমানের কোনটিই যুদ্ধের উপযোগী ছিল না।

১৫ অক্টোবর সুলতান মাহমুদ নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে পৌঁছান। সুলতান মাহমুদকে তখন কিলোফ্লাইটের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিলোফ্লাইটের দায়িত্ব পাওয়ার পর সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে তিনটি বেসামরিক এয়ারক্রাফটকে যুদ্ধবিমানের রূপান্তরের কাজ শুরু হয়। অন্যদিকে এসময় বৈমানিকদের নিয়ে প্রশিক্ষণের কাজও শুরু করেন তিনি। সাধারণত এই ধরনের প্রশিক্ষণে ৬ মাসের মতো সময় লাগলেও কঠোর এবং নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাত্র ১৫ দিনেই পুরো প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে প্রথমে পরিকল্পনা করা হয়েছিল ডাকোটা ডিসি-৩ দিয়ে ঢাকায় আক্রমণ করা হবে। কিন্তু ৩০ অক্টোবর সুলতান মাহমুদ মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান একে খন্দকারকে বলেন, 'আমাদের যে এয়ারক্রাফটগুলো আছে তার স্বল্প জ্বালানি দিয়ে ডিমাপুর থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে আক্রমণ সম্ভব নয়। আমাদের ত্রিপুরা থেকে মাঝে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হবে। তখন পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ২ নভেম্বর ত্রিপুরার কৈলাসহর থেকে পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও ঢাকা বিমানবন্দরে হামলার সিদ্ধান্ত হয়। 

কিন্তু শেষমুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব সফরে থাকায় অপারেশন স্থগিত করা হয়। 

পরবর্তীতে ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে ভারত এবং অপারেশন কিলোফ্লাইটকে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত মোতাবেক অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে পূর্বের ঢাকা বিমানবন্দরে হামলাকে চরম নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনা কররে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের ইউএসএসওর তেলের ডিপো ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

তৎক্ষণাৎ সুলতান মাহমুদরা কৈলাশহর হয়ে আগরতলার তেলিয়ামুড়াতে চলে আসেন। এবং এদিন রাতে অ্যালুয়েট থ্রি হেলিকপ্টার দিয়ে ইউএসএসওর তেলের ডিপো ধ্বংসের উদ্দেশ্যে রওনা করেন। প্রচণ্ড বিপজ্জনক এই অপারেশনে অংশ নিয়ে সুলতান মাহমুদ ও তার সহযোদ্ধারা দু দফা হামলা চালিয়ে ইউএসএসওর তেলের ডিপো ধ্বংস করেন।

নারায়ণগঞ্জে অপারেশন শেষে একইভাবে কৈলাশহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন সুলতান মাহমুদ। কিন্তু তারা যখন অবতরণের জন্য ফিরে এলেন তখন বেশ প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হলেন। কারণ অবতরণের রানওয়েটি ছিল মূলত একটি টিলা। কিন্তু রাতের বেলা সেই রানওয়েতে অবতরণের জন্য কোনো আলো নেই।

এরপরেই হঠাৎ সুলতান মাহমুদ দেখলেন রানওয়ে থেকে কেউ যেন টর্চ জ্বালছে। কিন্তু সেই টর্চের আলো যথেষ্ট ছিল না। সুলতান মাহমুদ বুঝতে পারলেন মূলত টর্চের মাধ্যমে রানওয়ের অবস্থান নির্দেশ করা হচ্ছে। 

হেলিকপ্টার অবতরণের পর সুলতান মাহমুদ দেখলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা তাদের অভিনন্দিত করতে এগিয়ে এলেন। কিলো ফ্লাইটের প্রথম আক্রমণ প্রায় অনেকাংশেই ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ জ্বালানি তেল। একই রাতে দ্বিতীয় অপারেশনে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম অটার বিমান দিয়ে ধ্বংস করে দেন পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির যাবতীয় তেলের মজুদ। যার দরুন জ্বালানির অভাবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রায় সমস্ত বিমানই অচল হয়ে যায়। পরবর্তীতে কিলো ফ্লাইটের ৫০টি অপারেশনের মধ্যে ৩০টি অপারেশনেই অংশ নিয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। 

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিনের সঙ্গে সিলেট শহর পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখোমুখিও হয়েছিলেন সুলতান মাহমুদ। সেদিন তাদের হেলিকপ্টারে গুলি লাগলেও সুলতান মাহমুদের উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার দরুণ সেই যাত্রায় তারা নিরাপদে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বাস্থানীয় ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। বারবার নিজের জীবন বিপন্ন হওয়া সত্ত্বেও মুহূর্তের জন্যও দমে যাননি সুলতান মাহমুদ। গেরিলা যুদ্ধ থেকে সম্মুখ যুদ্ধ, স্থলযুদ্ধ থেকে আকাশ যুদ্ধ, কোথায় ছিলেন না তিনি। নিশ্চিত ভবিষ্যতকে তুড়ি মেরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রার মাধ্যমে

 মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য তার যে অসীম অবদান তা কখনোই মুছে যাওয়ার নয়। সুলতান মাহমুদ থাকবেন বাংলার ইতিহাসে সুলতানের মতোই। তার বীরত্বগাঁথা লেখা থাকবে জাতির ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh 2025-26 budget

Budget to shrink amid fiscal strain

Bangladesh’s interim government is preparing to unveil a rare contractionary budget on June 2, driven by a sharp rise in interest payment that is crowding out fiscal space and forcing spending cuts.

12h ago