'সাংবাদিকতাকে রাজনৈতিক তৎপরতা ভাবতেন আবুল মনসুর আহমদ'
প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া বক্তারা বলেছেন, তিনি সাংবাদিকতাকে সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। তার সব কর্মকাণ্ডের মূলে ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ। সাংবাদিকতাকে তিনি রাজনৈতিক তৎপরতা ভাবতেন।
আবুল মনসুর আহমদকে একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে অভিহিত করে বক্তারা আরও বলেন, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ থেকে তিনি নাগরিকের অধিকার, বাক স্বাধীনতা এবং সমাজ পরিবর্তনের জন্য ক্রমাগত লড়াই করে গেছেন। একইসঙ্গে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার যে অসাধারণ সংমিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন, তা এখনো দৃষ্টান্তস্বরূপ।
আজ শনিবার বিকেলে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজাফফর আহমদ চৌধুরী মিলনায়তনে 'শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা ও প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান' শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এ বছর আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শত বছর পূর্ণ হলো। তিনি ১৯২৩ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক 'ছোলতান'-এ যোগদানের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। কালক্রমে একজন ওজস্বী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ হিসেবে নিজেকে পরিচিত করান তিনি।
আজকের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, 'আবুল মনসুর আহমদের অনেকগুলো পরিচয় ছিল। তিনি সাংবাদিক ছিলেন, সাহিত্যিক ছিলেন, রাজনীতিক ছিলেন, পেশায় আইনজীবী ছিলেন। আজ আমরা যাদের বুদ্ধিজীবী বলি আবুল মনসুর আহমদ তেমন একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, 'সাধারণভাবে সাংবাদিকতা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মধ্যে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ভেতরে, সমাজে—সেটা আমরা মর্মে মর্মে বুঝি। সে জন্য আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি, আমরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিরুদ্ধে বলি, আমরা হয়রানির বিরুদ্ধে বলি।'
'সেগুলো এই কারণে যে, রাজনীতি সাংবাদিকতাকে উপেক্ষা করে না, রাষ্ট্র সাংবাদিকতাকে উপেক্ষা করে না এবং আবুল মনসুর আহমদ যখন সাংবাদিকতা শুরু করেন ১০০ বছর আগে, তখন সমাজ আরও অনগ্রসর ছিল। আমরা ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্যে ছিলাম, আমাদের সামনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ছিল। সেখানে তিনি কৃষকের সমস্যাকে প্রধান মনে করেছেন। রাজনীতির বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল।'
এ ছাড়া আবুল মনসুর আহমদের মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্ত ছিল মন্তব্য করে এই লেখক-শিক্ষাবিদ বলেন, 'তার সব কাজের মধ্যে আমরা মেরুদণ্ডের দৃঢ়তা দেখি। তিনি যা বুঝেছেন সেটা বলেছেন, স্পষ্টভাবে বলেছেন এবং কাউকে তোয়াক্কা করে বলেননি। সেই মেরুদণ্ড আমাদের প্রয়োজন।'
একইসঙ্গে সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার যে অসাধারণ সংমিশ্রণ আবুল মনসুর আহমদ ঘটিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ বলে অভিহিত করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ'র সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, 'জনপ্রিয় মতামতই যে সবসময় সঠিক মতামত নয়, আবুল মনসুর আহমদ সেটা বুঝিয়েছেন। একদিকে জনস্রোত এবং চিন্তার যে গড্ডালিকা সেটাকে ভিন্নভাবে ভাববার বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার তার ছিল।'
আবুল মনসুর আহমদ সাংবাদিকতাকে একটা রাজনৈতিক তৎপরতা ভাবতেন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, 'ভাষার রাজনীতি নিয়ে ওই সময়ে আবুল মনসুর আহমদ ছাড়া এ অঞ্চলের একটা মানুষও আলোচনা করেননি।'
আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আর রাজী কথা বলেন আবুল মনসুর আহমেদর ভাষাচিন্তা নিয়ে। তার অভিমত, 'আবুল মনসুর আহমদের শিক্ষাটা এই যে, মানুষের মুখ থেকে ভাষাটা কলমে আসুক। কলম থেকে মানুষের মুখের ভাষাটা না যাক।'
দৈনিক সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক ফারুক ওয়াসিফ আবুল মনসুর আহমদের কৃষক-প্রজা পার্টির মাধ্যমে সমাজ রূপান্তরের বিপ্লবী ভূমিকা, সাংবাদিকতার ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষার ও সংস্কৃতির রাজনীতির গোড়াপত্তন করা এবং এই দেশের একজন ভিশনারি হিসেবে তার অবস্থান নিয়ে আলোচনা করেন।
তিনি বলেন, 'যখন আমার জাতি নিপীড়িত, তখন সাংবাদিকতার গুরুত্ব যেকোনো সময়ের চেয়ে জরুরি। সাংবাদিক ছাড়া জাতির মুক্তি সম্ভব না। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটা পারবেন না। এ জন্যই কৃষক-প্রজা পার্টি সংবাদপত্রে বিনিয়োগ করেছিল।'
ফারুক ওয়াসিফ আরও বলেন, 'তিনি (আবুল মনসুর আহমদ) সাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্য করেছেন, রাজনীতি করেছেন। কিন্তু নিজের সম্পর্কে তিনি বলছেন, "আমি একজন সাধারণ দেশপ্রেমিক, আত্মসম্মানী বাঙাল।"'
আবুল মনসুর আহমদের সব কর্মকাণ্ডের ভেতরেই আত্ম অনুসন্ধানের একটা জায়গা ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে 'শতবর্ষে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার প্রাসঙ্গিকতা' নিয়ে আলোচনা করেন সাংবাদিক ও গবেষক কাজল রশীদ শাহীন। সেখানে তিনি বলেন, 'তিনি (আবুল মনসুর আহমদ) ছিলেন একজন পেশাদার সাংবাদিক ও সম্পাদক। কিন্তু কর্মগুণে, নিষ্ঠা, প্রেম ও সাধনায় সাংবাদিকতা-সম্পাদকতা, সংবাদপত্র শিল্পকে এবং এর ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠার পথকে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিকভাবে এমন এক মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যা থেকে একজন সংবাদপত্র মালিকের, একজন সাংবাদিক-সম্পাদকের, একজন অধ্যাপকের, একজন তাত্ত্বিক গবেষকের নেওয়ার আছে অনন্য সব উপাদান।'
আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতার শতবর্ষ উদযাপনের এ আয়োজনে শারীরিক অসুস্থতার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। তবে, অনলাইনে যুক্ত হয়ে দেওয়া সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ আগত আলোচক ও অতিথিদের ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন তিনি।
আলোচনা পর্ব শেষে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। পুরস্কার হিসেবে তাদের বই, সনদ ও নগদ অর্থ দেওয়া হয়।
তিন বিভাগে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীরা হলেন—জুবায়ের ইবনে কামাল, আবুল হাসনাত, ফরিদ উদ্দিন রনি, জি মোস্তফা, ফাইজা বিনতে হক, মেজবাহ উদ্দিন ফাহিম, রাবাত রেজা নূর, মাহবুব নাহিদ ও মোহাইমিন আহমেদ আশিক।
Comments