রেলের ১৩ প্রকল্প: খরচ বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৬০ শতাংশ, সময় বেড়েছে সাড়ে ৯ বছর
২০০৭ সালের অক্টোবরে খুলনায় একটি নতুন স্টেশন ভবন নির্মাণ ও বেনাপোল স্টেশনের অপারেশনাল ক্যাপাসিটি বাড়াতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
ওই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকা এবং ২ বছরের মধ্যে প্রকল্পের সময়সীমা ধরা হয়।
তবে এই প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ২০১৮ সালে, মূল সময়সীমার সাড়ে ৯ বছর পর। কিছু কাজ তখনো অসম্পূর্ণ ছিল, যা রাজস্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ করে সম্পন্ন করা হয়।
ওই প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকায়, যা মূল ব্যয়ের চেয়ে ১১৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীরগতি ও ব্যয়বৃদ্ধির ঘটনা এটাই একমাত্র না। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সম্পন্ন করা ১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টিতেই নির্ধারিত সময়সীমার চেয়ে ৫ মাস থেকে সাড়ে ৯ বছর পর্যন্ত বেশি সময় লেগেছে। এর মধ্যে ৪টি প্রকল্প ছিল সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য।
সম্প্রতি ইমপ্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন ডিভিশন (আইএমইডি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৪.৭৩ শতাংশ থেকে ২৬০.৮১ শতাংশ পর্যন্ত ৭টি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে।
১৩টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টি রেললাইন স্থাপন এবং স্টেশন নির্মাণের জন্য; ৫টি ভবিষ্যত প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই পরিচালনার জন্য এবং সিগন্যাল স্থাপন, পুরনো রেল কোচ মেরামত ও রেল রিফরমের জন্য ১টি করে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে সময় ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পেছনে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা, প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন, কাজের পরিধি বৃদ্ধি এবং ক্রয় প্রক্রিয়া রেট শিডিউল পরিবর্তনকে দায়ী করা হয়েছে।
তবে নিম্নমানের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিকল্পনা, রেলওয়ে ও এর ঠিকাদারদের ক্ষমতার অভাব এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বল অবস্থার জন্য দায়ী রেল কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা না থাকাকে এর জন্য দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে রেলওয়ের ২৮টি চলমান প্রকল্পের অধিকাংশই সময়ের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে, এর মধ্যে ৬টির বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় ১ দশক ধরে পিছিয়ে আছে।
২০১০ সালের অক্টোবরে রেলওয়ে ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ধলারচর পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়।
প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুনে শেষ হয় এবং ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল করিডরের সক্ষমতা বাড়াতে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত দ্বিতীয় ৮০ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প হাতে নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ হয় ৫০১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এটি শেষ হয়েছিল ২০১৮ সালের অক্টোবরে, ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, যা প্রাথমিক বরাদ্দের চেয়ে ২৬০ শতাংশ বেশি।
২০১৬ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে কোথায় কোথায় ওভারপাস বা আন্ডারপাস প্রয়োজন এমন স্পট চিহ্নিত করতে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। দেড় বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ আরও ১ বছর বাড়ানো হয়।
দুর্বল বাস্তবায়নের প্রবণতার একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ১০০টি পুরনো রেলকোচ মেরামত করার প্রকল্প। ৫৮ কোটি ৩০ লাখ টাকার প্রকল্পটি নির্ধারিত সময় ও ব্যয়ের মধ্যে শেষ হয়েছে।
আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যথাযথ সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন এবং সঠিক প্রকল্প নকশা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রেলের সক্ষমতা বাড়ানো এবং রেল মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, দুর্বল সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের কারণে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নকশা পরিবর্তন বা কাজ বৃদ্ধি পায়। অনেক সমস্যা শুরুতে প্রায়ই অন্তর্ভুক্ত করা হয় না বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয় না, যাতে প্রকল্পের কম খরচ দেখানো যায়। সেই সমস্যাগুলো বাস্তবায়নের মাঝখানে আসে, যার ফলে প্রকল্প সংশোধন করতে হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'তারা (বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো) উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করে। কারণ তারা জানে যে একবার একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হলে, এটি বাতিল করা হবে না... শুধু রেল নয়, সবক্ষেত্রেই প্রকল্প বাস্তবায়নের এই অনিয়ম যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।'
সময় ও ব্যয় বাড়ার জন্য কোনো প্রকল্প কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয় না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, 'রেলের এত বড় সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। রেল প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের সংখ্যা খুবই সীমিত, যার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'বাস্তবায়নে দেরির কারণে প্রকল্পগুলোর আর্থিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতা হ্রাস পায় এবং জনগণের যে সেবা পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়। বাস্তবায়নের মাঝখানে প্রকল্প সংশোধনের এই সংস্কৃতি শেষ হওয়া উচিত।'
সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ত্রুটি থাকার ফলে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মোহাম্মদ মফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, 'স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করার পর অনেক ক্ষেত্রে কাজের পরিধি পরিবর্তন বা বাড়াতে হয়। প্রকল্পের পুনর্বিবেচনা এবং বাস্তবায়নে দেরির পেছনে অন্যান্য প্রধান কারণ হলো ইউটিলিটি স্থানান্তর, জমি অধিগ্রহণ এবং জনবলের অভাব।'
তবে এত বড় সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নে রেলের সক্ষমতার অভাবের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
Comments