মুক্তিযুদ্ধে ‘সিরিজ গণহত্যা’
৬৮ বছরের শিখা বিশ্বাস আজও বুঝতে পারেন না, তিনি সৌভাগ্যবান কি না।
গত ৫২ বছর ধরে তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন তিন তিনটি গণহত্যা প্রত্যক্ষ করার স্মৃতি। মাত্র তিন দিনের মধ্যে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার।
১৯৭১ সালের মে মাসে শিখার বয়স ছিল ১৬ বছর। খুলনার বটিয়াঘাটার পৈতৃক ভিটা থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য তিনি ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে তার চোখের সামনেই খুলনার বাদামতলা, চুকনগর ও ঝাউডাঙ্গায় তিনটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে যায়।
অলৌকিকভাবে তিনবারই তিনি বেঁচে যান। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেই নির্মম বর্বরতা আজও তাকে তাড়া করে বেড়ায়।
তিনি বলেন, '৫২ বছর অনেক সময়। কিন্তু রক্তাক্ত এত এত লাশের কথা ভুলব কীভাবে? এত বছর পরেও মনে হয়, এই তো যেন সেদিনই সব চোখের সামনে ঘটে গেল।'
মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলা গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অসংখ্য মানুষ মুখোমুখি হয়েছিলেন বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। গণহত্যার মধ্যে কেউ কেউ সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচতে পারলেও বাকি জীবনের জন্য তাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। শিখা বিশ্বাসের মতো অসংখ্য মানুষ গণহত্যায় হারিয়েছেন প্রিয়জন, পরিবারের সদস্য-স্বজন।
তাদের অনেকে আজও বেঁচে আছেন আমাদেরকে সেই নৃশংসতার গল্প বলার জন্য, যা তারা সেই নয় মাসের যুদ্ধে দেখেছেন—যে যুদ্ধ আমাদের এনে দিয়েছে স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধকালে কিছু মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন একাধিক গণহত্যাও। গণহত্যার সেই ক্রমধারাকে গণহত্যা গবেষকেরা 'সিরিজ গণহত্যা' হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের ১৯, ২০ ও ২১ মে যথাক্রমে খুলনার বাদামতলা, চুকনগর ও সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গায় এমনই এক সিরিজ গণহত্যা সংগঠিত হয়।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায় অবস্থিত বাদামতলা। চুকনগরের অবস্থান খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ও ঝাউডাঙ্গার অবস্থান সাতক্ষীরা সদর উপজেলায়। বাদামতলা থেকে চুকনগর বাজারের দূরত্ব সাড়ে ১৬ কিলোমিটার, অন্যদিকে চুকনগর থেকে ঝাউডাঙ্গার দূরত্ব প্রায় ৩৩ কিলোমিটার।
'সিরিজ গণহত্যা'টির বিষয়ে জানতে খুলনার বটিয়াঘাটার ফুলতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ, হেতালবুনিয়াসহ কয়েকটি গ্রামের ১০ প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।
তারা জানান, খুলনায় সংঘটিত সিরিজ গণহত্যাটির মধ্যে প্রথমটি সংঘটিত হয় ১৯ মে। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ২ নম্বর বটিয়াঘাটা ইউনিয়নের ফুলতলা, দেবীতলা, বসুরাবাদ গ্রাম ও বাদামতলা বাজারে এই গণহত্যা চলানো হয়।
গৌরাঙ্গ নন্দীর 'বাদামতলা গণহত্যা' বই থেকে জানা যায়, 'মুক্তিযুদ্ধের মে মাসে বটিয়াঘাটার দেবীতলা গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রামপালের গণপরিষদ সদস্য কুবের বাবু। কদিনের মধ্যেই গোয়েন্দা মারফতে তাঁর অবস্থানের খবর খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর শিবিরে পৌঁছে গেলে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে ধরতে অভিযানে নামে। ১৯ মে সকালে পাকিস্তানি বাহিনী গানবোট সহযোগে বটিয়াঘাটার কাজীবাছা নদী ধরে ফুলতলা গ্রামের মঠের পাশে এসে ভিড়ে। প্রথমে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে ফুলতলা, বসুরাবাদ, দেবীতলা গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ করে ব্রাশফায়ার করে কয়েকজনকে হত্যা করে। পরে রাজাকারদের সহযোগিতায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েক'শো লোককে বাদামতলা বাজারে ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে।'
দেবীতলা গ্রামে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলেন বসুরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা নিরঞ্জন মণ্ডল (৭০)। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি এই কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনার একটি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই প্রত্যক্ষদর্শী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'দেবীতলা থেকে ওরা আমাকে সহ পাঁচজনকে ধরে খালপাড়ে নিয়ে যায়। যখনই ওরা গুলি করবে, এমন সময় আমি খালের কাটা দিয়ে লাফ দিয়ে ক্রলিং করে খালের কচুরিপানার মধ্যে ঢুকে যাই। মাথার ওপর কচুরিপানা থাকায় ওরা আমাকে দেখতে পারেনি। তবে আমার বড়ভাইকে ওরা গুলি করে মেরেছে।'
বাদামতলায় সংঘটিত গণহত্যার পর প্রাণ বাঁচাতে গ্রামবাসীরা খুলনার ডুমুরিয়ার চুকনগরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কারণ, সে সময় ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার পথ হিসেবে চুকনগরের রুটটিই ছিল আদর্শ।
মে মাসের শুরুতে চুকনগর ও এর আশেপাশের এলাকায় উদ্বাস্তুদের ভিড় বাড়তে থাকে।
মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত 'চুকনগর গণহত্যা' বই থেকে জানা যায়, '১৯ মে চুকনগরে লাখো শরণার্থীর ঢল নামলে আটলিয়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান পাকিস্তানি বাহিনীর সাতক্ষীরা ক্যাম্পে খবর দেন। এরপরই পাকিস্তানি বাহিনী ২০ মে সকালে চুকনগরে এক প্লাটুন সেনা পাঠায়। ২০ মে সকাল ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি গাড়ি চুকনগর-সাতক্ষীরা রোড ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলার সামনে এসে থামে। পরে পাকিস্তানি সেনারা তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে এক ভাগ মালোপাড়া-রায়পাড়ার দিকে, একভাগ বাজারের দিকে আরেকভাগ নদীর ধারে গুলি করতে করতে এগিয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে চুকনগর পাতখোলার মাঠে জমায়েত হাজার হাজার মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাতে শুরু করলে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলমান এই গণহত্যায় শহীদ হন অন্তত ১০ হাজার শরণার্থী।'
বসুরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা গৃহিণী শিখা বিশ্বাস চুকনগর গণহত্যারও প্রত্যক্ষদর্শী। শিখা জানান, সারা রাত পায়ে হেঁটে চলার পর তবেই পরদিন সকালে চুকনগরে পৌঁছেছিলেন তারা।
শিখা বলেন, 'সারা রাত হাঁটার পর ক্ষুধা-পিপাসায় তখন প্রাণ যায় যায়। এমন সময় গুলি শুরু হয়ে গেল। কেউ বাগানে, কেউ ঝোপঝাড়ে, বাঁশঝাড়ে গিয়ে লুকালো। আমরা তখন একটা দোকানঘরে গিয়ে লুকালাম। এদিকে গুলির শব্দ চলছে তো চলছেই। বিকেলের দিকে একসময় গুলি শেষ হয়ে হলো, আর্মিও চলে গেল।'
গণহত্যা শেষে কী দেখলেন? জানতে চাইলে শিখা বলেন, 'সে আর বলার মতো দৃশ্য না। খালে, মাঠে, বিলে, বাগানে—যেদিকে তাকাই দেখি মরা পাখির মতো লাশ পড়ে আছে। হাঁটতে গেলে পায়ের কাছে এসে লাশ ঠেকছে।'
চুকনগরের গণহত্যায় যেসব শরণার্থী প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন, তাদের গন্তব্য তখন সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গার পথে। কারণ, ঝাউডাঙ্গা বাজার থেকে ভারতীয় সীমান্তের দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। আর একবার ভারতে প্রবেশ করতে পারলেই অন্তত প্রাণে বাঁচতে পারবেন তারা।
দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'খুলনা একাত্তর: আমার মুক্তিযুদ্ধ' বই থেকে জানা যায়, '২১ মে সকালে শরণার্থীরা যখন ঝাউডাঙ্গা বাজার ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় এসে পৌঁছায় তখন যশোর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দুটি ট্রাক সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে ঝাউডাঙ্গা বাজারের পার্শ্ববর্তী পাথরঘাটা গ্রামের শান্তি কমিটির একজন সদস্য ট্রাক দুটোকে থামায়। তখন শান্তি কমিটির সেই সদস্যের কথা শুনে পাকিস্তানি সেনারা বাজারের দক্ষিণ দিকের কালভার্টের উপর এসে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি সেনাদের বাজারের দিকে আসতে দেখে এসময় শরণার্থীরা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। তখন পলায়নরত শরণার্থীদের ধরতে গুলিবর্ষণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। একইসঙ্গে তারা গুলিবিদ্ধ ও পলায়নরত শরণার্থীদের আটক করে কালভার্টের উপর সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। এই গণহত্যায় শহীদ হন কয়েকশো মানুষ।'
ঝাউডাঙ্গা গণহত্যারও প্রত্যক্ষদর্শী শিখা বিশ্বাস বলেন, 'মিলিটারির দুটি ট্রাক যখন ব্রিজের সামনে এসে পৌঁছালো, তখন আমরা বাজারে বসেছিলাম। ওরা ট্রাক থেকে নেমেই গুলি শুরু করলো। আমরা দৌড়ে একটা ঘন বাঁশঝাড়ের মধ্যে গিয়ে লুকালাম। মিলিটারি প্রায় এক ঘণ্টার মতো মানুষ মেরেছিল।'
চুকনগর ও ঝাউডাঙ্গা গণহত্যার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী খুলনার বটিয়াঘাটার দেবীতলা গ্রামের বাসিন্দা প্রকাশ চন্দ্র রায়। গণহত্যা পরবর্তী সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'এক নারীর পা গুলিতে চূর্ণ হয়ে গেছে। ওই নারী আমাকে জল খাওয়ানোর অনুরোধ করলে আমি পাশের খাল থেকে কোষভর্তি জল নিয়ে তাকে খাইয়ে দিতেই তিনি বললেন, "বাবা এই তুই কি দিলি, এ তো জল না রক্ত!" সামনে এগুতেই দেখি এক বাচ্চা মৃত মায়ের স্তন পান করছে। আরেক কদম এগোতেই দেখি আরেকটা শিশু পাশে পড়ে থাকা মৃত মাকে বলছে, এই মা'মনি তুই উঠিস না কেন; সব মানুষ তো চলে গেল।'
কেবল খুলনায়ই নয়, মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের অন্যত্রও সিরিজ গণহত্যা হয়েছে বলে জানান গবেষকেরা।
১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার 'জাটিভাঙা' ও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার 'ঢাপঢুপ বিলে' দুটি বড় গণহত্যা হয়। গবেষকদের দাবি, এটিও সিরিজ গণহত্যা ছিল।
ওই দুটি গণহত্যায় শহীদ হয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ। দুটি গণহত্যাই প্রত্যক্ষ করেছেন, এমন প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন।
গণহত্যা গবেষক ডা. এম এ হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিরিজ গণহত্যা চালানোর সবচেয়ে বড় কারণ নৃশংসতা প্রদর্শন এবং বাস্তবায়ন করা। এর মাধ্যমে স্বল্পসময়ে অধিক মানুষ হত্যা করা যায়। এটি সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যার বাস্তবায়ন।'
কেবল খুলনা ও ঠাকুরগাঁও নয়, ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গাতেই সিরিজ গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে জানান এম এ হাসান।
তিনি বলেন, 'পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারের অধিবাসীদের মধ্যে অনেকে যেমন ২৫ মার্চ রাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তেমনি ২ এপ্রিল কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাতেও তারা আক্রান্ত হয়েছেন।'
এম এ হাসান আরও বলেন, 'অন্য যেকোনো গণহত্যার তুলনায় সিরিজ গণহত্যা অধিকতর পরিকল্পিত ও নৃশংস হয়ে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী মূলত শরণার্থীদের যাতায়াতের রুটেই সিরিজ গণহত্যা চালিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট, রুয়ান্ডা, কম্বোডিয়া, বসনিয়াতেও সিরিজ গণহত্যা হয়েছে। বর্তমানে গাজাতেও এমনটি হচ্ছে।'
Comments