কোটিপতি প্রার্থীদের প্রাধান্য দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো: টিআইবি

অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে বেশি সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন।
টিআইবির ‘নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?’ শীর্ষক বিশ্লেষণে কোটিপতি প্রার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। ছবি সৌজন্য: টিআইবি

আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোটিপতি প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বছরে ১ কোটি টাকা আয় করেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা এবার সর্বোচ্চ ১৬৪ জন। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৭ শতাংশই কোটিপতি। শতকোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এমন প্রার্থীর সংখ্যা ১৮। সর্বোচ্চ কোটিপতির প্রদর্শিত সম্পদমূল্য ১ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা।

নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের জমা দেওয়া মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে 'নির্বাচনী হলফনামার তথ্যচিত্র: জনগণকে কী বার্তা দিচ্ছে?' শীর্ষক এই বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।

সেই সঙ্গে 'হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি' শীর্ষক একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করেছে টিআইবি। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে থাকা ড্যাশবোর্ড থেকে ভোটাররা নিজ এলাকার প্রার্থীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবেন।

সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচন ও আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি জানিয়েছে, অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচনে বেশি সংখ্যক কোটিপতি প্রার্থী অংশগ্রহণ করছেন। নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোটিপতি প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগে কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন ২৭ শতাংশের কিছু বেশি। সেটি ১৫ বছরের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ শতাংশে। অন্যদিকে স্বতন্ত্র নির্বাচন করা প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশই কোটিপতি।

প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত একজন তার বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্য হলফনামায় গোপন করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছে টিআইবি। তারা বলেছে, সরকারের মন্ত্রিসভার অন্তত একজন সদস্যের নিজ নামে বিদেশে একাধিক কোম্পানি থাকার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। মন্ত্রী ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি বিদেশে সক্রিয়ভাবে আবাসন ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ সব কোম্পানির মোট সম্পদ মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।

হলফনামায় দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রার্থীর নামেই বড় আকারের (সর্বোচ্চ ৮১৩ একর) ভূমির মালিকানা রয়েছে। অথচ, দেশের আইন (ল্যান্ড রিফর্ম অ্যাক্ট-২০২৩) অনুযায়ী একজন ব্যক্তির ভূমির মালিকানা পাওয়ার সর্বোচ্চ সীমা (কৃষি জমির ক্ষেত্রে ৬০ বিঘা এবং অ-কৃষি জমি সহ যা ১০০ বিঘা পর্যন্ত যেতে পারে)।

হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রার্থীদের গত ১৫ বছরে সম্পদবৃদ্ধির একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণও হাজির করেছে টিআইবি। তুলনামূলক হিসাবে দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের কারো কারো আয় সর্বোচ্চ ২ হাজার শতাংশের বেশি বেড়েছে। পাঁচ বছরে এমপিদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আয় বৃদ্ধির হার ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ এবং ১৫ বছরে এই হার ৭ হাজার ১১৬ শতাংশ। একইভাবে, পাঁচ বছরে এমপিদের সর্বোচ্চ সম্পদ বৃদ্ধির হার ৫ হাজার ৪৭০ শতাংশ। ১৫ বছরে এই হার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৩ শতাংশ। মন্ত্রী/প্রতিমন্ত্রীদের পাঁচ বছরে আয় সর্বোচ্চ বেড়েছে ২ হাজার ১৩৪ শতাংশ, একই সময়ে পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ শতাংশ এবং ১৫ বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৩৫০ শতাংশ।

টিআইবি বলেছে, প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া সম্পদের বিবরণী কতটা সঠিক ও পর্যাপ্ত এবং আয় ও সম্পদ কতটা বৈধ উপায়ে অর্জিত তা যাচাইয়ের সুযোগ থাকলেও করা হয় না। হলফনামায় প্রার্থীরা নিজেদের অর্জিত সম্পদ কতটা দেখিয়েছেন, পুরোটা দেখিয়েছেন কিনা কিংবা দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন কিনা-তা যাচাই করা প্রয়োজন।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'হলফনামায় উঠে আসা সকল তথ্যই সঠিক কি-না, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। কেননা যেভাবে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে হলফনামায় সম্পদের হিসাব প্রকাশ এক ধরনের দায়সারা গোছের আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। হলফনামায় মিথ্যা বা অপর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ করা, আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে যে সকল প্রতিষ্ঠানের এ সব বিষয় খতিয়ে দেখার কথা, তারাও এ ব্যাপারে নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করছে।

তিনি আরও বলেন, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের অনেকেরই অবিশ্বাস্য গতিতে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্পদের এই বৃদ্ধি তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং তা না হলে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোনো উদ্যোগ না থাকা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।

টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, 'প্রার্থীদের সম্পদ বৃদ্ধির হার খুবই ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছে। আমরা দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারিনি। অথচ একটা শ্রেণি এতটাই সম্পদশালী হয়েছে যে ভাবলে হতবিহ্বল হয়ে পড়তে হয়ে। অন্যদিকে একটি বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠী দিন-আনে-দিন খায় অবস্থাতেও নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো এটা না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যে রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করছে, তাদের সময়ই তো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম। গুটিকয়েক মানুষের উন্নয়ন হয়েছে-অথচ আমরা শুধু বলে বেড়াচ্ছি আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। অল্প সংখ্যক মানুষের আগ্রাসী ভূমিকার অধীনে আমরা চলে গিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই এই গুটিকয়েক মানুষ তাদের স্বার্থের বাইরে কাজ করছে না।'

Comments