পাখির ছানা বাঁচাতে গিয়ে ৬ বছর ধরে চিকিৎসাধীন লিওন

লিওনের বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়েন মুক্তা। সংসার চালাতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। তার মা, লিওনের নানী, একটি রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। এই দুজনের আয়ে এখন সংসার চলে তাদের।
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে বোনের সঙ্গে লিওন
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে বোনের সঙ্গে লিওন। ছবি: শাহীন মোল্লা/স্টার

প্রতিদিনের মতো সেদিনও বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলছিল ১০ বছর বয়সী লিওন। হঠাৎ সে দেখতে পায়, একটি ছোট্ট টিয়াপাখি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে মাটিতে কাতরাচ্ছে। চিৎকার, আতর্নাদে মা পাখি তার শিশুটিকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে।

সবুজ টিয়া দুটিকে দেখতে ভিড় জমায় অনেক লোক। তবে কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।

লিওনের বয়স যখন এক বছর তখন তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে তাদের ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকে মা-ই একমাত্র অভিভাবক লিওন ও তার বোনের। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দুই সন্তানকে বড় করছেন তিনি।

'আমি যখন মা পাখিটিকে চিৎকার করতে দেখি তখন আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। কেউ বাচ্চা পাখিটিকে সাহায্য করছিল না। সবাই তাকিয়ে দেখছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে সেটিকে হাতে তুলে নিই। তারপর গাছে উঠি,' লিওন জানায়।

তবে, শিশু পাখিটিকে মায়ের কাছে ফেরাতে পারেনি লিওন। ভারসাম্য হারিয়ে গাছের নিচে কংক্রিটের দেয়ালে আছড়ে পড়ে সে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে লিওন। মারাত্মক এই দুর্ঘটনায় ২১ দিন হাসপাতালে সংজ্ঞাহীন ছিল লিওন।

লিওনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। ২০১৮ সালের মে মাসে এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রায় ৬ বছর ধরে এখনো হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁতরাচ্ছে লিওন। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তার পরিবার।

সরেজমিনে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে লিওন ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের।

পরিবার জানায়, দুর্ঘটনার পরপরই লিওনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তিন সপ্তাহ পর তার জ্ঞান ফেরে। ছয় বছরে পাঁচ বার মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হয়েছে লিওনের। সর্বশেষ অস্ত্রোপচার হয়েছে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকার নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে।

ছেলেকে সুস্থ করতে দিনরাত লড়াই করে চলেছেন লিওনের মা মুক্তা রাণী। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম অস্ত্রোপচারের পর লিওন স্বাভাবিক ছিল। সে পড়াশোনা করছিল, সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু দেড় বছর পর, লিওন আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। আরেকটি অস্ত্রোপচার করতে হয়। এ নিয়ে তার পাঁচটি অস্ত্রোপচার করতে হলো।'

মুক্তা রাণী আরও বলেন, 'লিওনের বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে যান। তিনি অন্য এক নারীকে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। লিওন ও তার বড় বোনকে আমি একাই বড় করছি। তাদের বাবা কখনো কোনো খোঁজ নেন না।'

লিওনের বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়েন মুক্তা। সংসার চালাতে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। তার মা, লিওনের নানী, একটি রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। এই দুজনের আয়ে এখন সংসার চলে তাদের।

বছরের পর বছর ধরে লিওনের চিকিত্সার খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তারা।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে লিওন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, কাজের জন্য প্রায়ই মা আমাকে বাড়িতে রেখে বাইরে যেতেন। তখন আমি বাসায় খুব কান্নাকাটি করতাম, কষ্ট পেতাম। সেদিন যখন বাচ্চা পাখিটিকে চিৎকার করতে দেখি তখন আমার মনে হয় যেন আমি নিজেকে দেখছি। মা পাখিকে দেখে আমার নিজের মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। সেজন্য আমি পাখিটিকে সাহায্য করতে চেয়েছি। ওকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছি।'

লিওন এখন স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সে বড় হয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হতে চায়। তবে লিওনের এই স্বপ্ন পূরণের জন্য তার সুচিকিৎসার প্রয়োজন।

 

লিওনের চিকিৎসায় কেউ সাহায্য করতে চাইলে, দ্য ডেইলি স্টার তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago