তারা পুলিশ, ডাকাতিও করেন

গত ছয় মাসে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে এ ধরনের অপরাধে জড়িত সাত পুলিশ সদস্যের নামও প্রকাশ করা হয়েছে।
তারা পুলিশ, ডাকাতিও করেন
ছবি: আনস্প্ল্যাস

গত বছরের ২৩ জানুয়ারি রাতে দুবাই থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে নামেন প্রবাসী আবদুল্লাহ মুন্সি (২৪)। রাত ১১টার দিকে তিনি একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে খিলগাঁওয়ে তার ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে রওনা দেন।

অটোরিকশাটি বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামের কাছে এলে পেছন থেকে একটি মাইক্রোবাস সেটিকে ধাক্কা দেয়। সেসময় চার ব্যক্তি মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসেন এবং অটোরিকশাটিকে থামতে বলেন।

ওই চারজন নিজেদের পুলিশ সদস্য বলে পরিচয় দেন এবং অটোরিকশা থেকে আবদুল্লাহকে টেনে-হিঁচড়ে হাতকড়া পরিয়ে মাইক্রোবাসে তোলেন। এরপর চলন্ত মাইক্রোবাসে আবদুল্লাহর চোখ বেঁধে তাকে নির্বিচারে পেটান তারা। চিৎকার করলে তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় একটি মামলা করেন আবদুল্লাহ। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সেদিন চার পুলিশ সদস্য তার কাছ থেকে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা সমমূল্যের ৩৩৪ গ্রাম ওজনের দুটি সোনার বার এবং একটি মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়। পরে রাত দেড়টার দিকে তাকে পূর্বাচলের কাছে ছেড়ে দেয়।

তদন্তের পর এই অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বনানী থানার পুলিশ। অভিযুক্ত চার জন হলেন—কনস্টেবল রবিউল বেপারী, মো. আব্দুর রাজ্জাক, উজ্জল চন্দ্র বর্মণ ও মো. আজাদ।

গ্রেপ্তারের পর ঢাকার একটি আদালতে তোলা হলে তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন। এ মামলার তদন্ত এখনো চলমান। ওই চার আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত ছয় মাসে বনানী, বিমানবন্দর ও উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ এমন ছয়টি ডাকাতির মামলা তদন্ত করেছে। পুলিশ সদস্য, অভিবাসন কর্মকর্তা ও অপরাধীদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র এসব ঘটনায় জড়িত বলে জানা গেছে।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এই সংঘবদ্ধ চক্র প্রায়ই প্রবাসী বাংলাদেশিদের টার্গেট করে। তাদের কাছ থেকে স্বর্ণ লুট করে সেগুলো ভারতে পাচার করে।

গত ছয় মাসে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে এ ধরনের অপরাধে জড়িত সাত পুলিশ সদস্যের নামও প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন উপ-পরিদর্শক, দুইজন সহকারী উপ-পরিদর্শক ও চারজন কনস্টেবল।

এ ছাড়া তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করা বিমানবন্দরের ফায়ার অপারেটর দীনেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও ট্রাফিক সহকারী বাপ্পী শেখকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মো. শাহজাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। জড়িতরা যেই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এ ধরনের অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। পুলিশ সূত্র বলছে, অধস্তন ও মধ্যম পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের একটি অংশ ছিনতাই, মাদক চোরাচালান ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। ফলে দুই লাখ সদস্যের গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম নয় মাসে ৩০৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ৩১৮টি মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় সারাদেশে ৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের তথ্য পাওয়া যায়নি।

এর আগে ২০২২ সালে প্রায় এক হাজার ৭৩১ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বরখাস্ত বা বদলি হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ সদস্যরা যাতে অপরাধে না জড়ান, সেটি নিশ্চিত করতে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এটাই প্রথম পদক্ষেপ। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রয়েছে কি না, সেটি চিহ্নিত করার জন্য কঠোর মনিটরিং করতে হবে।'

'কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত,' বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের অপরাধের ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া ও তদন্তের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় তা অভিযুক্ত পুলিশকে পুনরায় অপরাধমূলক কাজ করার স্বাধীনতাই দেয়।

'বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি দ্রুত হওয়া উচিত। এ ছাড়াও, অপরাধের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্পৃক্ততা কমাতে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকা উচিত', বলেন তিনি।

সংঘবদ্ধ চক্র

আবদুল্লাহ মুন্সির মামলায় গ্রেপ্তার সাতজনই একইরকম আরও দুটি ডাকাতির ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে জানা গেছে। অন্য দুটি ঘটনায়ও ভুক্তভোগীরা ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, 'তারা পেশাগত উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করত। হতে পারে তারা অপরাধীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে এ চক্রে যোগ দিয়েছিল।'

আব্দুল্লাহ মুন্সি মামলা দায়েরের তিন মাস পর ১ এপ্রিল বিমানবন্দরের সামনে আরেকটি ডাকাতির চেষ্টার সময় চার কনস্টেবলকে হাতেনাতে ধরে ফেলে পুলিশ। এবারও ভুক্তভোগী ছিলেন একজন প্রবাসী শ্রমিক। পরদিন পুলিশ ওই চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে।

এরপর ৩ এপ্রিল দুবাইপ্রবাসী জাকির হোসেন ও দ্বীন ইসলামের কাছ থেকে প্রায় ৪৬৪ গ্রাম ওজনের চারটি স্বর্ণের বার লুট করার অভিযোগে একই চারজনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, বিমানবন্দরের সামনে।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী এই চক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যারা আইনতভাবে স্বর্ণ বহন করে দেশে নিয়ে আসে তাদের সম্পর্কে ওই কর্মচারীরা পুলিশ সদস্যদের খবর দেয়। তথ্য পাওয়ার পর কনস্টেবলরা অন্যান্য অপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে প্রবাসীদের ডাকাতি করে।

'ভারতে পাচার'

টঙ্গীতে একটি জুয়েলারি দোকানের মালিক গৌরাঙ্গ দত্ত। গত ২৩ ডিসেম্বর তিনি উত্তরা গাউসুল আজম মার্কেটের কাছে ২০০ তোলা স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন।

মামলায় বলা হয়েছে, উত্তরার বাসা থেকে দোকানে যাওয়ার পথে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে চারজন লোক গৌরাঙ্গর গাড়ি থামায় এবং স্বর্ণ ও তার ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

পরে পুলিশের তদন্তে জানা যায়, এএসআই গিয়াস উদ্দিন, এএসআই মো. ওবায়দুর ও এসআই মো. আব্দুল আলিম সেদিন গৌরাঙ্গের জিনিসপত্র লুট করেছিল। এ মামলা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত ৪ জানুয়ারি আদালতে জমা দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ভারতে স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের সম্পর্ক রয়েছে। তারা বাংলাদেশে লুট করা স্বর্ণ চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে।

এ ঘটনায় এএসআই গিয়াসকে গ্রেপ্তার করা হলেও ওবায়দুর ও আলীম এখনো পলাতক রয়েছেন। তাদের তিনজনকেই বরখাস্ত করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক সাফিন ইশতিয়াক রুবেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এ ধরনের অপরাধে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। আশা করছি শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব।'

ওই পুলিশ কর্মকর্তারা কী পরিমাণ স্বর্ণ চোরাচালান করেছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই গ্যাংয়ের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর তিনি বিস্তারিত জানাতে পারবেন।

Comments