ঢাকা গেটের ‘পাহারায়’ মীর জুমলার ‘বিবি মরিয়ম’
সেই সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝিতে মুঘল সেনাপতি মীর জুমলা বিবি মরিয়মকে এনেছিলেন ঢাকার আশপাশের নদী বেয়ে জনপদে এসে হানা দেওয়া মগ, আরাকানি ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমনের কাজে। এরপর থেকে চারশ বছরের এই স্মৃতির শহরে বাংলার সুবেদারের আসাম অভিযানের সঙ্গী অতিকায় এই কামানের অবস্থান বদলেছে বার বার। এ দফায় তা থিতু হলো সংস্কারের পর স্বরূপে ফেরা ঐতিহাসিক ঢাকা গেট- এ।
মীর জুমলার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই ঢাকা গেট বহু বছরের অযত্ন-অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছিল প্রায়। সংস্কারের পর বায়ান্ন বাজার, তেপ্পান্ন গলির এ নগরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই ফটক এবার স্বরূপে ফিরেছে। আর সুবেদারের আদরের বিবি মরিয়মকে ওসমানী উদ্যান থেকে সরিয়ে এনে বসানো হয়েছে পুরোনো আদলে সংস্কার করা ঢাকা গেটের পাশেই।
আজ বুধবার বিকেলে ফটকটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরের কাছে জরাজীর্ণ এই ফটকের নান্দনিকতা ফেরাতে ২০২২ সালে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ডিএসসিসি। প্রায় ৮২ লাখ টাকা ব্যায়ে গত বছরের মে মাসে শুরু হওয়া এই সংস্কার কাজ শেষে আজ এটি উদ্বোধন করেছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন।
প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের অধ্যাপক আবু সাঈদের নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ ফটকটির নতুন নকশা তৈরি করেন। সেই নকশার আদলেই সংস্কার করা হয়েছে এটি।
এই কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে এটি খুব ছোট একটি প্রকল্প হলেও গুরুত্বের বিচারে এর প্রভাব অনেকখানি। ঢাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো এভাবে সংরক্ষণের আওতায় আনতে পারলে তা যেমন দেশের বাইরে থেকে আসা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, তেমনি ইতিহাসের আলোয় নিজেদের হারানো ঐতিহ্যকে খুঁজে নিতে পারবে এখনকার নতুন প্রজন্ম।
'ঢাকা গেট' কে বানিয়েছিলেন
ঐতিহাসিক এই গেটের তিনটি আলাদা অংশ আছে। এর একটি অংশ পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, মাঝখানের অংশ দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসিগামী সড়কদ্বীপে আর পূর্বের অংশ পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার সমাধির প্রবেশপথের সামনে।
গেটটি কে, কবে নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও প্রত্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ঢাকা কোষে বলা হচ্ছে, ঢাকার সীমানা চিহ্নিত করার পাশাপাশি এবং স্থলপথে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ সালের মধ্যে ফটকটি নির্মাণ করেছিলেন মীর জুমলা।
আবার ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার 'স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী ঢাকা' গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ব্রিটিশ আমলে ঢাকার প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ড'স ১৯২৫ সালের পর রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে রেসকোর্স তৈরি করেন। তখন মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য তিনি রেসকোর্সের উত্তর পূর্ব দিকে একটি রাস্তা তৈরি করেন। তখন ওই রাস্তার প্রবেশমুখে দুটি স্তম্ভ তৈরি করেন ড'স। পরে ওই স্তম্ভদুটি লোকমুখে মীর জুমলার গেট, ঢাকা গেট ও রমনা গেট নামে পরিচিতি পায়।
আবার স্তম্ভদুটি পরীক্ষা করে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক এ এইচ দানীও বলেছিলেন, এর গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচের।
এ বিষয়ে পুরনো আদলে ঢাকা গেটের নকশা করা অধ্যাপক আবু সাঈদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যেকোনো ধরনের রেস্টোরেশনের প্রথম ধাপে থাকে গবেষণা। এর মাধ্যমে দেখা হয় সংশ্লিষ্ট স্থাপনাটি আদিতে ঠিক কী অবস্থায় ছিল, কতটা পরিবর্তন হয়েছে—এমন নানাকিছু।
'ঢাকা গেটের ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গেল এই ঢাকা গেট তৈরি করেছিলেন মীর জুমলা। সময় পরিক্রমায় গেটটি হারিয়ে যায়। পরে ব্রিটিশ আমলে চার্লস ড'স আবার নতুন করে একটা গেট তৈরি করেন; যখন রমনা উদ্যান তৈরি হলো। ওটা ছিল একটা ছোট রাস্তার দুইপাশে দুইটা গেট।'
এরপর পাকিস্তান আমলে অ্যাটোমিক এনার্জি কমিশন উদ্বোধনের সময় রাস্তা চওড়া করার জন্য অর্ধেক গেট সরিয়ে এখনকার শিশু একাডেমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান আবু সাঈদ। কিন্তু মাঝের একটা একটা অংশ থেকে যায়।
আবু সাঈদ বলেন, 'গেটের ওপরে কিছু অলঙ্করনের কাজ ছিল। কর্নারের বুরুজগুলো ভেঙে গিয়েছিল। আমরা এই জিনিসগুলোকে আবার রেস্টোর করেছি। পুরানো অবস্থায় ফেরত আনার চেষ্টা করেছি।'
এর বাইরে স্থাপনাটিকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার পাশাপাশি পথচারীদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গেট ঘিরে থাকা চত্বরটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানান এই প্রত্মতাত্ত্বিক। বলেন, 'এটা তো এমন একটা লোকেশন, যেখানে স্থাপনাটি মানুষের চোখে পড়ত না এতদিন। তাই কাজের শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল রাস্তা দিয়ে কোনো মানুষ হেঁটে গেলে এমনকি মেট্রোরেলে চড়ে যাওয়ার সময়ও যাতে স্থাপনাটি সবার নজরে আসে। এজন্য আমরা সেখানে একটা চত্ত্বর করেছি। যেখানে বসার ব্যবস্থা আছে, লোকজন এপার থেকে ওপারে যেতে পারবে; যাতে সবটা মিলিয়ে একটা কমপ্লেক্স মনে হয় আগের মতো।'
আবু সাঈদ জানান, এই কমপ্লেক্সের মেঝে তৈরিতে দুর্মূল্য খনিজ মধ্যপাড়ার গ্রানাইট ব্যবহার করা হয়েছে। কাটা হয়নি একটি গাছও। তার দাবি, ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে এটি একটি ল্যান্ডমার্ক প্রজেক্ট।
ঢাকাবাসীর 'গর্বের ধন' বিবি মরিয়ম
বিবি মরিয়মকে বলা হয় ঢাকাবাসীর গর্বের ধন। ১৭৭৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন রবার্ট লিন্ডস। তিনি লিখেছিলেন, ঢাকায় গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই। লালবাগ দূর্গ, বড় কাটরা, তাঁতিবাজার আর টঙ্গীর পুল কিছুই তাকে আকৃষ্ট করেনি। শুধু একটি জিনিসই করেছে। তা হলো, ঢাকার একটি কামান।
সপ্তদশ গোড়ার দিকে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করলে এখানে নানা প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে জলদস্যুদের উপদ্রবও।
সে সময় জলদস্যু দমনে ও ঢাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু কামান তৈরি করা হয়। এর মধ্যে দুটি কামান ছিল বিখ্যাত। একটির নাম কালে খাঁ জমজম ও অন্যটি বিবি মরিয়ম।
এ সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায়, সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন। তিনি ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় যতগুলো কামান ব্যবহার করেন, সেগুলোর মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহৎ। যুদ্ধশেষে বিজয়ী হয়ে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারীঘাটে স্থাপন করেন। বুড়িগঙ্গার মোগরাই চরে রাখা হয় কালে খাঁ জমজমকে। পরবর্তীতে নদীভাঙ্গনে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায় কালে খাঁ জমজম।
মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, কথিত আছে যে বুড়িগঙ্গায় কালে খাঁ জমজম ডুবে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকেরা প্রায় নদী থেকে কামানের গর্জন ভেসে আসতে শুনতেন। তারা বিশ্বাস করতেন, এ গর্জনের অর্থ হলো, কালে খাঁ তার সঙ্গিনী মরিয়মকে ডাকছে।
এ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক নথিপত্রের তথ্য বলছে, সোয়ারীঘাট থেকে সরিয়ে ১৮৪০ সালে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াল্টার্স বিবি মরিয়মকে চকবাজার এলাকায় স্থাপন করেন। এরপর আরও কয়েকবার স্থান বদল হয় কামানটির।
১৯২৫ সালে ঢাকা জাদুঘরের পরিচালক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর উৎসাহে বিবি মরিয়মকে সদরঘাটে আনা হয়। এরপর ১৯৫৭ সালে ডিআইটির সভাপতি জিএ মাদানী তৎকালীন ডিআইটি অ্যাভিনিউ তথা গুলিস্থানে আনেন বিবি মরিয়মকে। সেখানে তিন যুগ অবস্থানের পর ১৯৮৩ সালে এটিকে ওসমানী উদ্যানে আনা হয়।
আর এ দফায় মীর জুমলার নাম জড়িয়ে থাকা ঢাকা গেটের সঙ্গে বিবি মরিয়মের যুগলবন্দী কতকাল স্থায়ী হবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে।
Comments