‘ওপারে আধঘণ্টার পথ, এ পাড়েই বসে আছি তিনদিন’

কাজিরহাট ফেরিঘাটে গত কয়েকদিন ধরে কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, প্রতিদিন পারাপারের অপেক্ষায় থাকছে ৩-৪ শতাধিক ট্রাক। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

লালমনিরহাটের বুড়িমারী থেকে পাথরবোঝাই ট্রাক নিয়ে সোমবার মানিকগঞ্জে গত সোমবার পৌঁছানোর কথা ছিল চালক সুরুজ্জামানের। রোববার রাতে তিনি পাবনার কাজিরহাট ফেরিঘাটে পৌঁছান। নদী পার হলে মাত্র আধাঘণ্টার পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। 

অথচ, আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত ট্রাক নিয়ে নদী পার হতে পারেননি সুরুজ্জামান। সামনে ট্রাকের বিশাল সারি, কখন পার হবেন তাও বুঝতে পারছেন না তিনি। 

বিকেলে সরেজমিনে কাজিরহাট ফেরিঘাটে গেলে কথা হয় ট্রাকচালক সুরুজ্জামানের সঙ্গে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'লালমনিরহাট থেকে মানিকগঞ্জ পৌঁছাতে গেলে কাজিরহাট ফেরিঘাট ব্যবহার করলে ১০০ কিলোমিটারের বেশি পথ কমে যায়। পাথরবোঝাই লোড গাড়ি নিয়ে যমুনা সেতু দিয়ে যাওয়ার চেয়ে নদী দিয়ে যাতায়াত সহজ। তাই সবসময় কাজিরহাট-আরিচা রুট দিয়েই চলাচল করি।'

কিন্তু, গত চার দিন ধরে ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করে নিজের কপালকেই দুষছেন সুরুজ্জামান। 

তার সামনে তখনও প্রায় ১০০-১৫০ গাড়ির সারি, কখন এগুলো পার হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। 

একই অবস্থা চুয়াডাঙ্গা থেকে পশুখাদ্য বহন করা ট্রাকচালক নাহিদ হাসানের। সোমবার ঘাটে পৌঁছালেও, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ফেরির দেখা পাননি তিনি। 

নাহিদ জানান, সোমবার রাতে তিনি যখন ঘাটে পৌঁছান তখন তার সামনে প্রায় ৩ শতাধিক গাড়ি। ফেরিঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরের লাইনে দাঁড়িয়ে তিনদিন ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মাত্র এক থেকে দেড় কিলোমিটার আগাতে পেরেছেন।

নাহিদের সামনে আজ বিকেল পর্যন্ত প্রায় ২ শতাধিক গাড়ি, পেছনেও কয়েকশ গাড়ি। অভিযোগ করে বলেন, 'পেছনের অনেক গাড়ি ঘাটের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে আগে পার হয়ে যাচ্ছে। আর আমি পেছনেই পড়ে আছি।'

গত ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এ রুটের ৪টি ফেরির ট্রিপের সংখ্যা প্রতিদিন ১২-১৬টি থেকে কমে ৮-১০টিতে নেমেছে। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

তবে এ অভিযোগ মানতে রাজি নয় কাজিরহাট ফেরিঘাট কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে ফেরিঘাটের ম্যানেজার মো. ফয়সাল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঘন কুয়াশার কারণে প্রতিদিন ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। গত প্রায় ১০ দিন ধরে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ থাকছে।'

প্রতিরাতেই দীর্ঘসময় ঘন কুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায়, ঘাটে গাড়ির বিশাল লাইন হয়ে গেছে। তবে নিয়মমাফিক গাড়ি পারাপারের জন্য তারা কাজ করছেন বলে দাবি করেন তিনি।

কাজিরহাট ফেরিঘাট সূত্রে জানা গেছে, কাজিরহাট-আরিচা রুটে ৪টি ফেরি দিয়ে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় ১২-১৬টি ট্রিপে কমপক্ষে ২৮০-৩০০ ট্রাক পার করা হয়। কিন্তু, গত ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় প্রতিদিন ৮-১০টি ট্রিপের বেশি সম্ভব হচ্ছে না। এতে দিনে ১৫০-১৮০টি গাড়ি পার হতে পারছে।

এ কারণে, কাজিরহাট ঘাটে প্রতিদিনই শতাধিক অপেক্ষমাণ গাড়ির সারি তৈরি হচ্ছে।

এদিকে ট্রাকচালকরা বলছেন, ট্রাকের জন্য কাজিরহাট ফেরিঘাটে নেই ন্যূনতম কোনো সুযোগ- সুবিধা। ঘাট এলাকায় নেই কোনো টার্মিনাল। 

ফলে, দিনের পর দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাদের। এতে গাড়ি ও মালামালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হয় তাদের। 

ফেরিঘাটে ভালো কোনো হোটেল না থাকায়, এভাবেই খাবার খেতে হচ্ছে অপেক্ষারত চালক ও হেলপারদের। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

পাশাপাশি চালক ও হেলপারদের জন্য কোনো বাথরুম-টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় রাস্তায় মানবেতর দিন কাটছে তাদের। 

ঘাটে অপেক্ষারত ট্রাকচালক ইস্রাফিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় চার দিন ঘাটে। গোসল, খাওয়া, বাথরুম কোনোকিছুর ঠিক নেই।'

সবচেয়ে দুর্ভোগ হচ্ছে খাওয়া দাওয়ায়। ঘাটে ভালো কোনো হোটেল নেই। দিনের পর দিন ঘাট এলাকায় অতিরিক্ত দামে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে তাদের। এতে আয়ের বেশিরভাগ অংশ শেষ হয়ে যাচ্ছে। 

ইস্রাফিল বলেন, 'একটি ট্রাক চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকায় নিয়ে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত চারদিনের জন্য চালক ও হেলপার ৫ হাজার টাকা পায়। কিন্তু এখানে ঘাটেই বসে থাকতে হচ্ছে ৩-৪ দিন। এতে প্রতিদিন ৫০০-৭০০ টাকা খাবার খরচ হচ্ছে তাদের। আয়ের কিছু টিকিয়ে রাখাও দায় হয়ে গেছে।'

এ বিষয়ে ঘাট কর্তৃপক্ষও একমত। তাদের বক্তব্য, কাজিরহাটে কোনো টার্মিনাল না থাকায় ট্রাক চালক ও হেলপাররা কিছুটা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। 

ইতোমধ্যে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানান ফেরিঘাটের ম্যানেজার মো. ফয়সাল।

তিনি বলেন, 'ফেরি চলাচলে বিপর্যয় একটি সাময়িক ব্যাপার। আবহাওয়া ভালো হয়ে গেলে ফেরি চলাচলে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। প্রকৃতির বৈরিতার কারণে আমাদের কিছুই করার নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

5h ago