'যারা পত্রিকা পড়ে, তারা চুরি করে না'

ছবি: শেখ এনাম/স্টার

ছাতার নিচে কিছু দৈনিক পত্রিকা ও কয়েকটি ম্যাগাজিন রাখা। পাশের টুলে একটা বাক্স। বাক্সে খুচরা পয়সা, কিছু টাকা। বোঝা যাচ্ছে, এটি একটা পত্রিকার দোকান। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই দোকানের কোনো বিক্রেতা নেই।

দোকানি কোথায় জানতে চাইলে পাশের ডাব বিক্রেতা বলেন, 'কী নিবেন? নিয়ে টাকা রেখে যান।' 
ডাব বিক্রির পাশাপাশি এই দোকানও তিনি চালান কি না জানতে চাইলে বলেন, 'পত্রিকা বিক্রেতা নামাজে গেছেন, অপেক্ষা করলে তার দেখা মিলতে পারে।'

প্রায় আধা ঘণ্টা পর দেখা মিললো পত্রিকা বিক্রেতা মো. আবুল বাশারের (৫৫)।  নামাজে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, এটা ঈমানের (বিশ্বাসের) পরীক্ষা। যারা পত্রিকা পড়ে, তারা কেউ চুরি করে না- এই বিশ্বাস তার আছে। তাই দোকান নিয়ে কখনো চিন্তা করেন না।

'পত্রিকা রাখা আছে, টাকার বাক্স রাখা আছে, আমার কাজ কী? আমার দোকান থেকে যারা পত্রিকা কেনে, তারাই আমার দোকানের বিক্রেতা। কেউ দাঁড়িয়ে থেকে পত্রিকা পড়েন, তারাই দেখাশোনা করেন। টাকা খুচরা করে রাখেন। ১০ বছর ধরে এভাবে চলছে, কোনোদিন পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা আর টাকার অংকে কোনো গোলমাল হয়নি,' বললেন তিনি।

ছবি: শেখ এনাম/স্টার

আশপাশের ব্যবসায়ীদেরও নজর থাকে তার দোকানে, জানান তিনি। তার সঙ্গে কথা বলার সময় বেশ কয়েকজন ক্রেতার দেখা মেলে। তারাও বলেন, এরকম অনেক হয়েছে যে, আবুল বাশার দোকানে নেই। তারা পত্রিকা নিয়ে বাক্সে টাকা রেখে চলে গেছেন।

'অন্য এলাকা হলে কী হতো জানি না, এই এলাকার মানুষজনও অনেক ভালো,' এক ক্রেতা জানান। তিনি দোকানে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন। বলেন, 'আমি পত্রিকা পড়ি সময় তার দোকানের খেয়াল রাখি। অনেকেই এখানে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ে। ওই সময় তো তারাই বিক্রেতা।'

আবুল বাশার জানালেন, পত্রিকার ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত তিনি তিন দশক ধরে। শুরুতে লাইনসম্যান হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। বছর দশেক হলো তিনি নিজেই লাইনের (নির্ধারিত এলাকা) দায়িত্ব নিয়েছেন। বনশ্রীর তিনটি ব্লকের বাসায় বাসায় তিনি সাইকেলে চড়ে পত্রিকা বিলি করেন। তার অধীনে কর্মচারীও আছে দুজন।

এখন কর্মচারীরাই বাসায় বাসায় পত্রিকা দেন। যখন তাদের কেউ একজন থাকে না, নিজেই পত্রিকা বিলি করতে বের হন। তখনও দোকান খালিই থাকে। 

'করোনা এসে আমাদের অনেক লস করে দিয়ে গেছে। আগে এই এলাকায় পত্রিকার গ্রাহক ছিল এক হাজারের বেশি, এখন মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ জন। দিনে দেড়-দুই হাজার টাকা আয় হয়। এর মধ্যে কর্মচারীদের বেতন আর চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের সংসার। ভালোই চলে, আলহামদুলিল্লাহ। তবে বড় ছেলে কাতারে গেছে কাজ করতে, তার চাকরিটা ভালো পড়েনি। উল্টো দেশ থেকে টাকা পাঠাতে হয়। ছোট ছেলে ইলেকট্রিকের কাজ করে, ড্রাইভিং শিখছে। এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে আর এক মেয়ে গ্রামের স্কুলে পড়ে,' আবুল বাশার বলেন।

ছবি: শেখ এনাম/স্টার

তিনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় এসেছিলেন আশির দশকে। তখন থেকেই পত্রিকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাঝখানে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে ৯০ দশকে গিয়েছিলেন কুয়েত, ২০০০ সালে মালদ্বীপ। এক বার ছয় মাস আর একবার ১৮ মাস পর দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। 'পত্রিকার ব্যবসার সাথে আমার ভাগ্য জড়িয়ে গেছে। কাজ করতে করতে একটা ভালোবাসা হয়েছে। এখন আর কী করব?,' বলেন তিনি।

তবে তিনি সুখী জীবনের বৃত্তান্ত দিলেন এভাবে—'ভোর সকালে কাজ শুরু করি। বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবার খাই। তারপর আর তেমন কোনো কাজ নেই। এভাবেই ভালো আছি। আমার আর এক ভাইও বাড্ডা এলাকায় পত্রিকা বিলির কাজ করেন।'

'অনলাইন আসাতে আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছে। মানুষ তো এখন পত্রিকা পড়ে অনলাইনে। তারপরও ভালোই চলছিল। তবে করোনার কারণে যে টাকা দিয়ে লাইন কিনেছিলাম, তার থেকে লস হয়েছে। আগে যত অফিস আদালতে পত্রিকা রাখতো, সে সংখ্যাও অনেক কমেছে,' বলেন তিনি। তবে পত্রিকাগুলো তার নিজের টিকে থাকার স্বার্থে অনলাইনে গেছে, এমনটাও তিনি বুঝতে পারেন।

ছবি: শেখ এনাম/স্টার

দোকানী ছাড়া দোকান করার কথা তার মাথায় এলো কীভাবে, জানতে চাইলে আবুল বাশারের মন্তব্য, 'লোকে আমার ব্যবসাকে বলে সৌদিয়া ব্যবসা। আমি কুয়েতে গিয়ে দেখেছি, ওখানেও এমন অনেক দোকানে বিক্রেতা নেই। জিনিস নেবেন, দাম দিয়ে যাবেন। আমি এখানে এই সিস্টেম তৈয়ার করছি।' 

তাতে এই এলাকায় তার অনেক শুভাকাঙ্খীও তৈরি হয়েছে বলে জানান।

এমনই এক শুভাকাঙ্খী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, এটি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের 'আমরা ভালো সমাজ নির্মাণে অঙ্গীকারাবদ্ধ' এই প্রতিশ্রুতির গুরুত্বপূর্ণ একটি ইন্ডিকেটর। বিশ্বাসের হৃৎপিণ্ড তৈরি হয়েছে এখানে। আশা করছি কেউ এসে ছোঁ মেরে এই হৃৎপিণ্ড উপড়ে ফেলবে না।'
 

Comments

The Daily Star  | English

Govt cuts interest rates on savings tools

Finance ministry lowers rates on four key savings instruments

2h ago