‘নিজের ঘর হবে আশায় খেয়ে-না খেয়ে টাকা জমিয়েছিলাম, ওরা নিয়ে পালিয়ে গেল’

‘নিজের একটা ঘর হবে এই আশায় খেয়ে-না খেয়ে টাকা জমিয়েছিলাম, ওরা নিয়ে পালিয়ে গেল’
কারওয়ান বাজারের মসজিদের সামনে ভিক্ষা করছেন বড়মিয়া। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার

কারওয়ান বাজারের মসজিদের সামনে গেলেই দেখা মেলে জবুথবু হয়ে বসে থাকা এক বৃদ্ধের। দুই বছর আগেও দিনমজুরের কাজ করে রুজি-রোজগার করতে দেখা যেত তাকে। কিন্তু এখন তিনি দুইবেলা ভিক্ষা করেন।

৫৫ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ কারওয়ান বাজার এলাকায় 'বড়মিয়া' নামে পরিচিত। তার প্রকৃত নাম শাহজাহান, বাড়ি বরিশালের কাওখালী এলাকায়। তিনি কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজারের সিঁড়িঘরে ঘুমান। কিছুদিন আগে তীব্র শীতের মধ্যেও তার সম্বল ছিল একটি মাত্র সোয়েটার ও খুঁজে পাওয়া দুটো ছালা।

'অভাব-অনটনের কারণে খুব ছোটবেলায় এক আত্মীয়ের হাত ধরে ঢাকায় আসি। ছোটবেলায় পথেঘাটে ভিক্ষা করতাম। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকে কারওয়ান বাজারে দিনমজুরের কাজ শুরু করি। গ্রামে নিজের একটা ঘর হবে এই আশায় খেয়ে-না খেয়ে টাকা জমিয়ে রাখি,' বড়মিয়া বলেন।

বড়মিয়া পড়াশোনা জানেন না, হিসাব-নিকাশের জ্ঞানও তেমন নেই। তাই বিশ্বস্ত লোকজনের কাছেই টাকা জমা রাখতেন তিনি। গত কয়েক বছরে তাকে ঠকিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কারওয়ান বাজারের অন্তত নয়জন ব্যবসায়ী। তার জমানো টাকায় কয়েকজন ব্যবসায়ীর বিদেশযাত্রার গল্পও লোকের মুখে মুখে ঘোরে।

কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের ফলবিক্রেতা সাইদুর রহমান বলেন, 'আমার দোকানের ডানে-বায়ে দুই দোকানদার ও এক দারোয়ানের কাছে তিনি নিয়মিতভাবে টাকা জমা রাখতেন। তাদের একজনের কাছে তার ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো জমা ছিল। তিনি পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে পারেন। টাকা জমা রাখার সময় কয়েকজনকে সাক্ষী রাখতেন। কার কাছে তার কত টাকা জমা আছে, সেটা কারওয়ান বাজারের সবাই জানে। আমাকেও সাক্ষী রেখে তিনি কয়েকজনের কাছে টাকা রেখেছেন।'

বড়মিয়া মসজিদের কিংবা মার্কেটের বারান্দায় ঘুমান। যাদের কাছে তিনি টাকা জমা রাখতেন, তারাই তাকে দুবেলা খাওয়াতেন। তাই দিনমজুর হিসেবে কাজ করে যত টাকা আয় করতেন, পুরোটাই তিনি জমাতে পারতেন।

ফুটপাতের আরেক ফল ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমার ব্যবসার জন্য টাকার দরকার ছিল। তখন আমি তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিই। ১০ দিনের মধ্যে আমি সে টাকা ফেরতও দিয়েছি। এরকম অনেক ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে টাকা নিত। তিনি কয়েকজনকে সাক্ষী রেখে টাকা দিতেন। কিন্তু অনেকেই সুযোগ বুঝে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। দুজন সৌদি আরব গেছেন, একজন মালদ্বীপ গেছেন।'

সরেজমিনে কারওয়ান বাজারের অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বাস করে রাখতে দিয়েছেন এমন নয়জন ব্যবসায়ী বড়মিয়ার প্রায় সাত লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন।

'এর আগে তারা টাকা ফেরত দিত, নিয়মিত আমাকে হিসাব দিত, খোঁজখবর রাখত। কিন্তু করোনার পর থেকে ব্যবসায়ীরা আমাকে টাকা নিয়ে ঘুরাচ্ছে। কেউ ১০ হাজার, কেউ ৫০ হাজার, কেউ এক লাখ নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে। কেউ আবার বারবার বলার পরেও টাকা ফেরত দিচ্ছে না।

'সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি সর্বশেষ ঘটনায়। কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে এক আখের রস বিক্রেতার কাছে কয়েক বছর ধরে আমি টাকা জমা রাখতাম। প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো তার কাছে জমা ছিল। সে বলেছিল আমাকে একটা ঘর তুলে দিবে। তারপর হঠাৎ একদিন শুনি সে সৌদি আরব চলে গেছে,' বড়মিয়া বলেন।

বড়মিয়া বিয়ে করেননি। বাড়িতে কে কে আছেন, জানতে চাইলে জানান, পরিবারের কারো সঙ্গেই তার যোগাযোগ নেই। যাত্রাবাড়ীতে এক বোন ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজে পাননি।

'আমি সারাজীবন পরিশ্রম করে টাকা জমিয়েছি গ্রামে নিজের একটা ঘর তোলার জন্য। কষ্টের টাকা নিয়ে তারা পালিয়ে গেল। এখন আমি আর টাকা জমাই না। ভিক্ষা করে খাওয়ার পয়সা উঠে গেলে আমি আর কোনো কাজ করি না। শুয়ে-বসে থাকি। যদি টাকাটা উদ্ধার করতে পারি, তাহলে আর ঢাকায় থাকব না। গ্রামে গিয়ে থাকব,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Israel welcomes 'all help' in striking Iran

Israel hits nuclear sites, Iran strikes hospital as conflict escalates

1d ago