নরসিংদী

ব্রহ্মপুত্রের শাখা ভরাট করে পাকিজা গ্রুপের রাস্তা-ভবন নির্মাণ

জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জানতাম না। নদ-নদীর প্রবাহ বন্ধ কিংবা দখলের কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে সরাসরি উচ্ছেদ করা হবে। এ ছাড়া, নদের দুই পাশের রাস্তা বন্ধ করারও সুযোগ নেই।’
নদী ভরাট
নরসিংদী সদর উপজেলায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখার অংশ ভরাট করে রাস্তা ও ভবন তৈরির অভিযোগ উঠেছে পাকিজা গ্রুপের বিরুদ্ধে। ছবি: স্টার

নরসিংদী সদর উপজেলায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা নদের একটি অংশ ভরাট করে রাস্তা ও ভবন তৈরির অভিযোগ উঠেছে পাকিজা গ্রুপের বিরুদ্ধে। এতে শাখা নদটির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

এ ছাড়া, নদের দুই পাশে জনসাধারণের চলাচলের জন্য তৈরি রাস্তা টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় এখন তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, তারা বিষয়টি জানে না। পরিবেশ অধিদপ্তরও জানিয়েছে একই কথা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে প্রায় ৯০৩ কোটি টাকা খরচে ছয়টি নদ-নদী পুনঃখনন করা হয়েছে।

২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল নরসিংদীর আড়িয়াল খাঁ নদী, হাড়িদোয়া নদী, পাহাড়িয়া নদী, মেঘনা নদী এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও এর শাখা নদ পুনঃখনন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়।

প্রায় ৯০৩ কোটি টাকা খরচে পুনঃখনন প্রকল্পে নদ-নদী বেশ কয়েকটি এলাকায় ভরাট হয়ে যাওয়া থেকে পুনরুদ্ধার করে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা দূরীকরণসহ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্যায় নদীর পাড় ভাঙন থেকে তীর রক্ষা, নদীপথে সঠিক নব্যতা ফিরিয়ে নৌ চলাচলের উন্নয়ন, পানির গুণগতমান উন্নয়ন, পানি সম্পদ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষাসহ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এটি শেষ হয় ২০২৩ সালের জুনে।

সদর উপজেলার শীলমান্দি ইউনিয়নের শেখেরচর এলাকায় পুনঃখনন করা ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদটির একটি অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে নিজেদের গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করেছে পাকিজা কটন স্পিনিং মিলিস লিমিটেড। পাশাপাশি নদের দুই পাড় দিয়ে জনসাধারণের চলাচলের জন্য তৈরি ঢালাই করা রাস্তা টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাস্তার ওপর তৈরি করা হয়েছে দোতলা ভবন।

নদী ভরাট
নদের দুই পাড় দিয়ে জনসাধারণের চলাচলের জন্য তৈরি ঢালাই করা রাস্তা টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগও আছে পাকিজার বিরুদ্ধে। ছবি: স্টার

স্থানীয়রা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, শেখেরচর এলাকায় পাকিজা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পাকিজা কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের অফিস ভবন শাখা নদটির পশ্চিম পাশে ও এর কারখানা নদের পূর্ব পাশে থাকায় অফিস ও কারখানায় যাতায়াতের সুবিধার্থে পাকিজা কর্তৃপক্ষ নদের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করে।

সম্প্রতি নদটি পুনঃখননের সময় কারখানা কর্তৃপক্ষের অনুরোধে সেতুটি অক্ষত রেখেই তা করা হয়। খননকাজ শেষ হওয়ার পরপরই নিজেদের চলাচলের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ সেতু থাকা সত্ত্বেও নদে মাটি ফেলে রাস্তা করে।

প্রায় ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের শাখা নদের পানি প্রবাহের জন্য সেই রাস্তার নিচে দুটি কংক্রিটের তৈরি পাইপ বসায় পাকিজা কর্তৃপক্ষ। তাদের তৈরি করা সেতুর উত্তর-পূর্ব অংশে রাস্তার ওপর দোতলা ভবন নির্মাণ করে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়। সেসময় স্থানীয়রা বাঁধা দিলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি বলে জানা গেছে।

কোতালিরচর এলাকার বাসিন্দা মো. তবারক হোসেন তনু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিজা গ্রুপ অনেক প্রভাবশালী। তারা নদটি দখল করতে করতে নালায় পরিণত করেছিল। পুনঃখননের ফলে পানি প্রবাহের আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু খনন শেষ করার পরপরই তারা নদটি ভরাট করে পানি প্রবাহের জন্য দুটো সরু পাইপ বসিয়ে কারখানার গাড়ি চলাচলের রাস্তা তৈরি করে। তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, কাউকে কর্ণপাত করেন না।'

ছোট মাধবদীর মো. আরিফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদটি পুনঃখননের ফলে পানি প্রবাহ কিছুটা বেড়েছিল। পাকিজা গ্রুপ রাস্তা তৈরি করায় এখন প্রবাহ নেই বললেই চলে। এ ছাড়া, পাকিজা কর্তৃপক্ষ টিনের বেড়া দিয়ে নদের এক পাশের সরকারি রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। নদের উত্তর-পূর্ব অংশে রাস্তা বন্ধ করে সেখানে রাতারাতি নতুন ভবন তৈরি করেছে। দেখার কেউ নেই। অভিযোগ করলে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। তাদের নিয়ে কেউ কথা বলেন না।'

নদী ভরাট
নিরাপত্তার স্বার্থে চলাচলের জন্য রাস্তাটি সাময়িক বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাকিজার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। ছবি: স্টার

নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আবুল মুনসুর মোল্লা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নদের ওপর সেতু নির্মাণ করেছে, এটা জেনেছি। তবে তা ভরাট করেছে, এমন তথ্য নেই। নদের জায়গা দখল করে থাকলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।'

নরসিংদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিজয় ইন্দ্র শংকর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গত বছরের জুন মাসে পুনঃখনন প্রকল্পের কাজ শেষ করে। আগামী জুন পর্যন্ত তাদের ডিফেক্টস লাইবিলিটি পিরিয়ড চলমান আছে। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প এলাকার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।'

জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বিষয়টি জানতাম না। নদ-নদীর প্রবাহ বন্ধ কিংবা দখলের সুযোগ নেই। দ্রুত উচ্ছেদ করা হবে। নদের দুই পাশের রাস্তা বন্ধ করারও সুযোগ নেই।'

পাকিজা কটন স্পিনিং মিলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) মো. মোসতাব আলী মুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারি না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কথা বলতে পারবে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির অপর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সেতু করা হয়েছে। রাস্তাটি সরিয়ে নিতে গেলে গ্যাসের পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গ্যাস বন্ধ হয়ে যাবে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। কারখানার ছয় হাজার শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য আগামী ঈদের ছয় দিন বন্ধের মধ্যে নদ থেকে রাস্তাটি সরিয়ে নেওয়া হবে।'

'নদের ওপর পাকিজার ভবন থাকলেও প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে নদের জায়গায় পাকিজার ভবন আর ভবনের জায়গায় নদ বাঁকা করে প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে চলাচলের জন্য রাস্তাটি সাময়িক বন্ধ আছে,' যোগ করেন তিনি।

Comments