শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অদম্য নূর আলম

‘কাজেই শান্তি। কাজ করি বলেই নিজের মধ্যে একটা জোর আছে যে আমি কারোটা খাই না। নিজে উপার্জন করে খাই। আমি জানি, যতদিন বাঁচব, ততোদিন আমাকে কাজ করতে হবে। যতদিন বেঁচে থাকব, কাজ করেই বাঁচব।’
প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই গত এক যুগ ধরে বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন নূর আলম। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক/ স্টার

মোহাম্মদপুর থেকে বাসে উঠেছিলাম। গন্তব্য শাহবাগ। জ্যাম থাকায় চোখে ঝিমুনি চলে এল। হঠাৎ কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতেই ঝিমুনি গেল ছুটে। ভাড়া বের করে পাশে তাকাতেই দেখি বাসের মেঝেতে বসে টাকা চাইছেন একজন। ঝিমুনি চোখে প্রথমে ভেবেছিলাম ভিক্ষুক। কিন্তু পরক্ষণেই দ্বিতীয়বার তাকাতে গিয়ে ভুল ভাঙল। না তিনি ভিক্ষুক নন, তিনি বাস কন্ডাক্টর। যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া সংগ্রহ শেষে দু'হাতে ভর করে চলে যান বাসের পাদানির সামনে। তারপর ডাকতে থাকেন 'জিগাতলা, সিটি কলেজ, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, চিটাগাং রোড।'

পথেই তার সঙ্গে আলাপ জমাই। নাম তার নূর আলম। জন্ম থেকেই নূর আলমের দুই পা বাঁকা। দুই পায়ে শক্তি না পাওয়ার ফলে দু'হাতে ভর করে চলতে হয় তাকে। ভাড়া নেওয়ার সময় নূর আলম এক হাতে ধরে রাখেন বাসের স্ট্যান্ড, অন্য হাতে সংগ্রহ করেন ভাড়া। কখনো যাত্রীরাই তার হাতে ভাড়া দিয়ে যান। শারীরিক এই অসীম প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেই গত এক যুগ ধরে বাস চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন নূর আলম। বর্তমানে নূর আলম কাজ করছেন রজনীগন্ধা পরিবহণের একটি বাসে।

মোহাম্মদপুর থেকে ছেড়ে আসা বাসটির গন্তব্য চিটাগাং রোড। তবে সেদিন যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় কথা বলার ফুসরত পান না নূর আলম। ফলে তাকে আর বিরক্ত না করে তার সঙ্গে যোগাযোগের মোবাইল নাম্বারটি নিয়ে নেমে পড়ি।

এরপর কদিন পরে এক দুপুরে নূর আলমে সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সেদিন নূর আলম কাজে যাননি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য সপ্তাহে তিন দিনের বেশি কাজ করতে পারেন না নূর আলম। যে কদিন কাজ করেন সেই কাজের উপার্জন দিয়েই সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তাকে চলতে হয়। কারণ বাসে যারা কাজ করেন তারা মাস অনুপাতের বদলে দিন অনুপাতেই কামাই করেন।

নূর আলমের সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। দিলখোলা নূর আলমও বলতে থাকেন হাজারো প্রতিবন্ধকতার মাঝে বয়ে চলা তার জীবন সংগ্রামের কথা। অন্য সব বাসের চালকের সহকারীর মতো কাজ করলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে নূর আলমের রয়েছে বহু সীমাবদ্ধতা।

যেমন বাস পরিস্কার, বাসে ঝাড়ু দেওয়া, ধোওয়া বা গ্লাস পরিস্কারের মতো কাজগুলো সাধারণত বাস চালকের সহকারী করলেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কাজটি করতে পারেন না নূর আলম। অবশ্য এজন্য যে তিনি কম পারিশ্রমিক পান তা কিন্তু নয়। বাসের মালিককে নির্ধারিত জমার টাকা দিয়ে বাকি টাকা ভাগাভাগি করে নেন নূর আলম ও বাস চালক।

নূর আলম যে বাসটিতে কাজ করেন সেই বাসের চালক মোহাম্মদ সজীব। তিনি বলেন, 'আমার কিছুটা কষ্ট হয় এটা ঠিক। কারণ বাস সাফ, ধোয়াসহ সব কাজ আমাকেই করতে হয়। কিন্তু উনি যতটুকু করছেন এটাই বা কম কী। উনার চেয়েও শারীরিকভাবে কতো ভালো লোক রাস্তায় ভিক্ষা করে। উনি যে কাজ করছেন এটাও অনেক কিছু। পা দুটো অচল হওয়ার পরেও এমন কজন করে। এরকম পরিশ্রমী মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না।'

অতি রোদ, গরম বা বৃষ্টি হলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে নূর আলমের জন্য। নূর আলম বলেন, 'গরমে বাসের মেঝে গরম থাকে। তখন বইসা কাজ করতে কষ্ট হয়। আবার বৃষ্টির সময়ে দেখা যায় যাত্রীর পায়ের জুতায় কাদা, ধুলা, বালি ময়লা থাকে। কাদা গায়ে এসে লাগে। পাদানির জায়গাতেও কাদা ময়লায় ভর্তি থাকে। সেখানেও আবার বসা যায় না। আবার ধরেন, ভিড় বেশি হলেও সমস্যা হয়। কারণ যখন ভিড় বেশি থাকে তখন ভেতরে ঢোকা যায় না। ওই অবস্থাতেই লোকের কাছে বারবার ভাড়া চাওয়া লাগে। কেউ কেউ আপনা থেকেই দেয়, তয় আবার কারো কারো কাছে তো দুই তিন বার চাওয়া লাগে। পরে দেখা যায় আমি পিছনে গেলাম তখন ওই সুযোগে ওই লোক নাইমা গেছে। তবে এটা ঠিক অনেকে নিজে থেকেই আগে আগে দিয়ে দেয়।'

তবে কখনো কখনো যাত্রীদের কটু কথাও শুনতে হয় নূর আলমকে। বাসে উঠে নূর আলমের চলাচলে সামান্য বাদানুবাদেই কেউ কেউ গলা উঁচিয়ে তাকে ভিক্ষা করতেও বলে। নূর আলম বলেন, 'আমরা এমন জায়গায় কাজ করি এখানে আসলে কেউ কারো কথা চিন্তা করে না। সবাই নিজের ধান্দায় থাকে।'

তবে কোনো কোনো যাত্রী নূর আলমকে কাজ করার জন্য সাধুবাদও জানায়। তেমনই একজন যাত্রী আল আমিন। তিনি বলেন, 'লোকটি যে এই শারীরিক অবস্থাতেও কাজ করছে এটি ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ক। বহু সুস্থ মানুষও আছে যারা হাত পাতে, মানুষের থেকে চেয়ে নিয়ে খায়। অথচ উনি শত কষ্ট হলেও কারো ক্ষতি করছেন না। নিজের পরিশ্রমে কাজ করে চলছেন। এটা অবশ্যই সম্মান পাওয়ার মতো।'

নূর আলম বলেন, মানুষের মধ্যে ভালো যেমন আছে খারাপও তেমন আছে। সবাই তো আর খারাপ হয় না। যাত্রীর কোনো কোনো কথায় কষ্টও লাগে। আবার কারো কারো কথায় খুশিও লাগে। কিন্তু লোকের কথা সব কানে তুললে তো আর হয় না। আমি জানি, আমাকে কামাই করতে হবে।'

নূর আলম থাকেন নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় এলাকার ছয় তলা বাড়ির ৬ষ্ঠ তলায়। প্রতিদিনই তাকে ৬ তলা থেকে অন্তত দুই বার হাতে ভর দিয়েই সিঁড়ি ভেঙে উঠতে ও নামতে হয়। তিনি বলেন, 'এই কাজটিও অনেক কষ্টের। কিন্তু কিছুই করার নেই।' একইসঙ্গে নিজের রান্না থেকে কাপড়চোপড় ধোয়া নিজের সব কাজ নিজেই করেন নূর আলম।

নূর আলমের পরিবার নোয়াখালীতে তার গ্রামের বাড়িতে থাকে। সেখানে আছেন তার বাবা, মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ভাই বোন। নিজের প্রত্যহ খাবার খরচ, বাসা ভাড়া আর সামান্য হাত খরচের টাকা রেখে প্রতি মাসেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচের টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দেন নূর আলম।

বাসে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ কীভাবে শুরু করলেন জানতে চাইলে নূর আলম বলেন, 'আমার ওস্তাদের নাম খোকন। তিনিই আমাকে প্রথম তার বাসে নিছিলো। আমি তখন কিছু করি না। একদিন উনি আমাকে বললেন, 'তুই আমার সাথে কাজ করবি। উনার নিজেরই গাড়ি ছিল। বললো, আমার লস হোক আর লাভ হোক। তুই আমার গাড়িতে কাজ কর। উনিই আমাকে প্রথম সুযোগ দিলেন। তো উনার বাসেই আমি প্রথম কাজ করলাম। যখন দেখলো আমি কাজটা পারি, তখন আমার মনে জোর আসলো, যে আমি কাজ করতে পারবো। এরপর সবাই কাজ দেখেই আমাকে নেয়।'

ফেনী নোয়াখালী রুটের সুগন্ধা পরিবহনে কাজের মধ্য দিয়েই বাসে চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন নূর আলম। পরবর্তীতে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। এরই মধ্যে নয়টি রুটের গাড়িতে কাজ করেছেন নূর আলম।

নূর আলম বলেন, 'কাজেই শান্তি। কাজ করি বলেই নিজের মধ্যে একটা জোর আছে যে আমি কারোটা খাই না। নিজে উপার্জন করে খাই। আমি জানি, যতদিন বাঁচবো, ততোদিন আমাকে কাজ করতে হবে। যতদিন বেঁচে থাকবো, কাজ করেই বাঁচবো।'

ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কি জানতে চাইলে মৃদু হেসে নূর আলম বলেন, 'আমার মেয়ে জান্নাতরে ডাক্তার বানাইতে চাই। যেন ডাক্তার হয়ে ও মানুষের সেবা করতে পারে। আমার যত কষ্টই হোক মেয়ে দুইটারে লেখাপড়া শিখামু। আর একটি বাসের মালিক হতে চাই। এজন্য প্রতিদিন কামাই থেকে সামান্য কিছু টাকাও জমাই।'

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago