আদালতের আদেশও ঠেকাতে পারেনি বালুখেকোদের, ‘পাহারায় পুলিশ’

আদালতের আদেশও ঠেকাতে পারেনি বালুখেকোদের, ‘পাহারায় পুলিশ’
পদ্মা নদীতে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন | ছবি: আনিস মণ্ডল

পদ্মা নদীর কুষ্টিয়া ঘেঁষে বয়ে চলা অংশে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজনের তত্ত্বাবধানে চলছে এই কার্যক্রম।

গত বছরের ২৯ মার্চ বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে পাবনার পাকশী পর্যন্ত পদ্মায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধের আদেশ দিয়েছিলেন।

সম্প্রতি সরেজমিনে কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, যে পয়েন্টে শতাধিক নৌকায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তার একপাশে কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর ইউনিয়ন, অন্যপ্রান্তে পাবনার হেমায়েতপুর।

বালু উত্তোলনের ফলে হেমায়েতপুরের ভবানীপুরে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে জমি। ভবানীপুরের কৃষক ইকবাল ব্যাপারী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত দুই বছরে আমাদের শতাধিক বিঘা ধান ও কলা বাগান নদীতে বিলীন হয়েছে। বালু কাটার পরিমাণ যত বাড়ছে, আমাদের জমিও নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে।'

এলাকার আরেক কৃষক রবিউল মণ্ডল বলেন, 'ফাঁড়ির পুলিশকে বসিয়ে রেখে বালু তোলা হচ্ছে। তাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র থাকে। এ নিয়ে কথা বলাও বিপদ।'

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে লক্ষ্মীকুণ্ডা নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাদের বালু তোলার বৈধ কাগজপত্র আছে।' 

একই বক্তব্য পাবনা নৌ পুলিশ সুপার রুহুল কবিরেরও। ফোন করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাস ট্রেডার্স, টনি ও খান এন্টারপ্রাইজসহ পাঁচটি কোম্পানিকে ১২টি পয়েন্টে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।'

তবে রিটের বিস্তারিত তথ্য, এমনকি রিট নম্বরও দিতে পারেননি তিনি। জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'আমি ছুটিতে আছি। এই মুহূর্তে মনে নেই।'

এভাবে বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন পাবনা সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামীমা সুলতানা। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অবৈধভাবে মাটি ও বালু উত্তোলনের খবর পেয়ে গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি। এ বিষয়ে আমরা তৎপর। সুস্পষ্ট তথ্য থাকলেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।'

বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনকে শতভাগ অবৈধ বলছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহেতেশাম রেজা। তিনি বলেন, 'একটি লিভ টু আপিলের কাগজ দেখিয়েছেন বালু উত্তোলনকারীরা। যে কোর্ট বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন, সেই কোর্টই এটি ডিসপোজ করবে। তার মানে এই না যে, বালু তুলতে বলেছে।'

জেলা প্রশাসক বলেন, 'বিআইডব্লিউটিএর একটি আইনগত মতামত তারা দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, উন্নয়ন কাজের জন্য বালু উত্তোলনের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নেবেন কিন্তু হাইকোর্টের ওই নির্দেশনা থাকায় বাণিজ্যিকভাবে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।'

গত বছরের ২০ অক্টোবর পদ্মায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন স্থানীয় ছয় সাংবাদিক। ওই ঘটনায় মামলা এখনো চলমান। এরপর কিছু দিন বন্ধ ছিল বালু তোলা। চার মাস বিরতি দিয়ে চলতি মাসের শুরুতে আবারও বালু উত্তোলন শুরু হয় কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর সংলগ্ন পদ্মা নদীতে।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের মামলার আসামি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান মণ্ডল। 

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, হান্নান মণ্ডল ছাড়াও বালু তোলা চক্রের নেতৃত্ব দেন পাবনার দোগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী হাসান, কুষ্টিয়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াছির আরাফাত তুষার ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে দুই ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান ও আলী হাসানের মোবাইল নম্বরে বারবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।

আরেক ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানাকে ফোন করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি হাটশ হরিপুর অঞ্চলে পদ্মা নদীতে বালু উত্তোলন করি না। ওখানে বালু উত্তোলন করেন হান্নান মণ্ডলরা।'

বালু উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা পেয়ে মনিটরিং টিম গঠন করে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আহ্বায়ক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও নৌ পুলিশের পরিদর্শককে সদস্য করে ওই কমিটি গঠন করা হয়।

জানতে চাইলে মনিটরিং টিমের আহ্বায়ক ভেড়ামারার ইউএনও আকাশ কুমার কুণ্ডু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক দিনে আমরা দুজনকে কারাদণ্ড দিয়েছি। অভিযান চলমান আছে, অভিযান চলবে। যে বালু তুলবে, তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক এহেতেশাম রেজা বলেন, 'বালু উত্তোলন ঠেকাতে গত ২ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালানো হয়। এ ছাড়া, ১২ ফেব্রুয়ারি বালু উত্তোলনের দায়ে চারজনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।'

নদী থেকে বালু উত্তোলনে হাইড্রোগ্রাফি সার্ভে জরুরি বলে জানান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষের শরীর যেমন, নদীর শরীরও তেমনই। এর এক জায়গায় অপরিকল্পিত গর্ত করলে তার প্রভাব পুরো নদীতেই পড়ে। সে ক্ষেত্রে নদীর গতি-প্রকৃতি বদলে দেখা দিতে পারে ভাঙন।

'মাফিয়াতন্ত্রকে সুযোগ দিতে গিয়ে সমগ্র নদীকে আমরা ঝুঁকিতে ফেলছি,' বলেন মোহাম্মদ এজাজ।

Comments

The Daily Star  | English
Nat’l election likely between January 6, 9

EC suspends registration of AL

The decision was taken at a meeting held at the EC secretariat

8h ago