ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের নিজ হাতে করা সুই-সুতার কাজের টেবিল ক্লথ

'দাদি যখন সুই-সুতোর কাজ করতেন তখন তিনি পাশে বসে দেখতেন। এভাবে তিনি দাদির কাছ থেকে সুই-সুতোর কাজ শিখেছেন'
স্মৃতি সংগ্রহশালায় ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের নিজ হাতে সুই-সুতার কারুকাজ করা টেবিল ক্লথ। ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/ স্টার

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের নিজ হাতে করা সুই-সুতার কারুকাজ করা একটি টেবিল ক্লথ স্থান পেয়েছে তার নামে করা স্মৃতি সংগ্রহশালায়। শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলছেন, দাদির কাছ থেকে এ কাজ শিখেছিলেন শহীদ রফিক। যে টেবিলের জন্য এটি তিনি তৈরি করেছিলেন সেই টেবিলটিও স্থান পেয়েছে সংগ্রহশালাতে।

গতকাল মঙ্গলবার রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গেলে সেখানে এসব স্মৃতিচিহ্ন দেখা যায়। দেওয়ালের সাথে কাঠের ফ্রেমে এই স্মৃতি সংগ্রহশালায় আরও স্থান পেয়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর একটি লুঙ্গি। সামনেই রাখা আছে তার ব্যবহৃত চারটি কাঠের চেয়ার।

ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/ স্টার

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলম ও তার মেজ ভাইয়ের ছেলে আব্দুর রফিক এই প্রতিবেদককে জানান, শহীদ রফিক পরিবারের জ্যৈষ্ঠ সন্তান হওয়ায় সবারই খুব আদরের ছিলেন। তার দাদি তাকে খুব ভালবাসতেন। পরিবারের সবার চেয়ে দাদির সঙ্গে ছিল তার বিশেষ সখ্যতা। দাদি যখন সুই-সুতোর কাজ করতেন তখন তিনি পাশে বসে দেখতেন। এভাবে তিনি দাদির কাছ থেকে সুই-সুতোর কাজ শিখেছেন।

শহীদ রফিক তার পড়ার টেবিলের জন্য এই টেবিল ক্লথটি তৈরি করেছিলেন। এটির দৈর্ঘ্য ৩ ফুট এবং প্রস্থ ২ ফুট। সাদা কাপড়ের ওপর করা সুই-সুতোর কারুকাজ করা একটি টেবিল ক্লথের ওপর বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি, ফুলসহ দুটি ফুলদানি। ছয় জায়গায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কথা। কিছু লেখা অস্পষ্ট। একটা লেখা হলো 'সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায়-কেউ কারো নয়, 'খালেক মালেক খোদা, তুমি পরওয়ার-রাখিও সকলকে পদেতে তোমার। তার নিজের নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল 'রফিক উদ্দিন আহাম্মেদ ও গাছ বাড়ি। যদিও শিক্ষা সনদসহ যাবতীয় কাগজপত্রে তার নাম রফিক উদ্দিন আহমদ।

একুশে পদকপ্রাপ্ত (মরণোত্তর) এই কৃতি মানুষের নিজগ্রাম মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার বলধরা ইউনিয়নের পারিল (বর্তমানে রফিকনগর) গ্রামে প্রতিষ্ঠিত রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের ভেতরের পূর্ব-উত্তর কোণে তৈরি করা হয়েছে এই স্মৃতি সংগ্রহশালা। এখানে শহীদ রফিকের কিছু স্মৃতিচিহ্ন থাকলেও একুশে পদক ও এসএসসি পাশের সনদপত্রসহ অনেক মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন এখনও জাদুঘরে আনা সম্ভব হয়নি বলে জানান রফিকউদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন।

ছবি: জাহাঙ্গীর শাহ/ স্টার

তিনি বলেন, 'আমি শুরু থেকেই এখানে গ্রন্থাগারিক হিসেবে আছি। এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হওয়ার ১৫ বছরের মাথায় গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমরা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র পেয়েছি। এখনও অনেক কিছু তার ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলমের কাছে রয়েছে। শিগগির সেগুলোও পেয়ে যাব। এগুলো পেলে জাদুঘরটি সমৃদ্ধ হবে। দর্শণার্থীরা এসব দেখতে আসবে।'

রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে বিভিন্ন ধরনের ১৬ হাজার বই আছে। এসব বইয়ের অধিকাংশ ১৭টি বুক সেলফে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এসব বই পড়ার জন্য ৮টি টেবিল ও ৪০টি চেয়ার রয়েছে। একসাথে ৪০ জন পাঠক সেখানে বসে বই পড়তে পারেন। শুরুতে ৪টি পত্রিকা রাখা হতো। কিন্তু গত দুই বছর ধরে কোনো পত্রিকা রাখা হচ্ছে না। একারণে পাঠকও কমে গেছে বলে জানালেন গ্রন্থাগারিক ফরহাদ হোসেন।

ভাষাশহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার বলধরা ইউনিয়নের পারিল গ্রামে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্দুল লতিফ ছিলেন মুদ্রণ ব্যবসায়ী। রাজধানীর বাদামতলীতে তার পারিল কমার্শিয়াল আট প্রেস নামে একটি প্রেস ছিল। মা রাফিজা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শহীদ রফিক ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ৭ ভাইবোনদের মধ্যে জীবিত আছেন দুই জন। তারা হলেন-৮৪ বছর বয়সী বোন আলেয়া বেগম বেনু ও ৭৩ বছর বয়সী ভাই মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ আলম। তার চার জন ভাইয়ের চার জনই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ নিজ এলাকার বায়রা হাই স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে এসএসসি পাশ করেন। পরে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে একাদশ বাণিজ্য শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকায় পারিবারিক মুদ্রণ ব্যবসা দেখাশোনার জন্য তিনি মানিকগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় চলে যান এবং জগন্নাথ কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন।

বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার সাথে তিনি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হোস্টেল প্রাঙ্গণে মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সেই গুলি রফিক উদ্দিন আহমদের মাথায় লাগে এবং তিনি শহীদ হন।

ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন শহীদ রফিক। তিনি বাঙালির জাতীয় চেতনা ও দেশপ্রেম জাগ্রতকরণে দিশারি হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।

শহীদ রফিকের এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ মানিকগঞ্জ জেলা শহরের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয় 'শহীদ রফিক সড়ক'। হেমায়েতপুর থেকে সিংগাইর হয়ে মানিকগঞ্জে ঢোকার প্রবেশ পথের বড় সেতুটির নামকরণও করা হয়েছে  'শহীদ রফিক সেতু' নামে। এছাড়া তার পৈত্রিক বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে বড় একটি শহীদ মিনার। গ্রামের নাম বদলে পারিল থেকে করা হয়েছে রফিক নগর। সেখানে ২০০৮ সালে নির্মিত হয়েছে শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। গতবছরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেখানে তৈরি করা হয় শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।

Comments