‘রহমতবঞ্চিত’ রহমতের চরের মানুষ
তিনটি জেলার তিনটি উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন এসে মিলেছে 'রহমতের চর' গ্রামে। তিস্তা নদীপাড়ের এই চরটি একসময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বাঁধ আর রাস্তা নির্মাণ হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেও এই চরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, কেউ তাদের খবর রাখেন না।
স্থানীয়রা জানান, কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়ন, রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর ইউনিয়ন ও গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন মিলিত হয়েছে রহমতের চরে। এখানে বসবাস করেন ১৫৬টি পরিবারের ৭০০ মানুষ।
তাদের অভিযোগ, এই চরে বসবাসকারীদের কেউ থেতরাই, কেউ তাম্বুলপুর আবার কেউ তারাপুর ইউনিয়নের ভোটার। এ কারণে কোনো ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিই এই চরের মানুষদের খোঁজ রাখেন না। শীতে এখানে বিতরণ করা হয় না শীতবস্ত্র, বর্ষায় বা বন্যায় মেলে না কোনো ত্রাণ সহায়তা।
চরটির নামকরণের বিষয়ে দুটি গল্প প্রচলিত আছে। স্থানীয়দের একাংশ মনে করেন, প্রায় ৫০ বছর আগে চরটি জেগে উঠেছিল। এই চরে প্রথমে অধিবাসী ছিলেন রহমত আলী। এ কারণে চরটি 'রহমতের চর' নামে পরিচিতি পায়। রহমত আলী মারা গেছেন ২০ বছর আগে।
আরেকটি অংশ মনে করেন, বন্যা আর নদীভাঙনে অনেক পরিবার বাস্তুহারা হয়ে অন্যান্য স্থানে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে সময় চরটি জেগে উঠলে ভাঙনকবলিতরা সৃষ্টিকর্তার রহমত মনে করে এখানে বসতি গড়ে তোলেন। এ কারণ তারা চরটিকে 'রহমতের চর' হিসেবে পরিচয় দেন।
সামরিক শাসক এরশাদের আমলে তিস্তাপাড়ে নির্মিত হয় বাঁধ। বাঁধের কারণে এই চরটি ভাঙন থেকে রক্ষা পায়। ১০-১২ বছর আগে বাঁধের সঙ্গে নির্মাণ করা হয় সংযোগ সড়ক।
চরের বাসিন্দা জরিমন বেগম (৫৮) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হামরাগুলা রহমতের চরের মানুষ। কিন্তু রহমত হামার কপালোত আর জোটে না। থেতরাই, তাম্বুলপুর আর তারারপুর ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যান কাইও হামার খবর নেয় না। এমার এটে গেইলে কয় ওমার কথা, আর ওমার ওটে গেইলে কয় এমার কথা। মাঝেমধ্যে হামারগুলার মনে হয় হামরা বোধায় বাংলাদেশের মানুষেই নোয়াই। সরকারি কোনো সাহায্য আইসলেও হামার কপালোত আর জোটে না।'
চরের আরেক বাসিন্দা সারমেলা বেওয়া (৬০) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো কাজোত থেতরাই ইউনিয়ন গেইলে কয় তাম্বুলপুর ইউনিয়নের কথা। ফের তাম্বুলপুর ইউনিয়ন গেইলে কয় তারাপুর ইউনিয়নের কথা। তারাপুর ইউনিয়ন গেইলে কয় থেতরাই ইউনিয়নের কথা। হামার কপালে খারাপ। আগোত হামার ঠিকানা নিয়া বেশি ঝামেলা হইছে। এ্যালা এ্যাকনা কম ঝামেলা হয়। কিন্তু হামরাগুলা সাহায্য সহযোগিতা এ্যাকনা কমে পাই।'
চরের কৃষক মোবাসসের আলী (৫৫) ডেইলি স্টারকে জানান, তাদের ভোটার কার্ড হয়েছে উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নে। থেতরাই ইউনিয়নে যেতে হলে তিস্তা নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এটা তাদের জন্য কষ্টের। পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর আর সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন তাদের কাছাকাছি। কিন্তু এই দুই ইউনিয়নে গেলে তারা কোনো সেবা পান না।
তিনি বলেন, 'হামরা রহমত চরের বাসিন্দা কিন্তু হামরা রহমতবঞ্চিত।'
থেতরাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রহমতের চরটি তিস্তার কারণে বিচ্ছিন্ন। এই চরে কয়েকটি পরিবার বসবাস করছে। তাদের কাছে ইউনিয়ন পরিষদের সেবা পৌঁছে দেওয়া কষ্টকর। প্রয়োজনে চরের বাসিন্দারা ইউনিয়ন পরিষদে আসেন এবং সেবা নেন।'
তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বজলুর রশিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চরে বসবাসকারীদের যারা তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভোটার, তারা নিয়মিত সেবা পাচ্ছেন। চরটি তিনটি ইউনিয়নের মিলনস্থল হওয়ায় নাগরিকদের সেবা পেতে একটু বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।'
তারাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের ভাষ্য, 'চরে তারাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা কম। তবে ওই চর থেকে আসা সবাই নাগরিক সেবা পেয়ে থাকেন।'
Comments