গ্রীষ্মের আগেই বান্দরবানে পানির তীব্র সংকট

ছবি:মংসিং হাই মারমা/স্টার

বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে বান্দরবানের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায়।

সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন এলাকা ও পাড়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়ে প্রায় সবকয়টি পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণাগুলো শুকিয়ে গেছে।

অনেক গ্রামে ঝিরির একেবারে শেষে পাথরের গর্তে অল্প পানি জমে আছে। এই পানি ৪-৫ হাজার ফুট দূরত্ব থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে এসে পাড়ার পাশে ৩০০ ফুট নিচে ঝিরিতে ড্রাম বসিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখান থেকেই পাড়াবাসী ও নারীরা পানি সংগ্রহ করছেন।

জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ম্রলং পাড়ায় গিয়ে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

এ পাড়ার ৬৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং সংসার সবই এই গ্রামে। আমার এই ৬৫ বছর বয়সে এতো পানির সংকট আগে দেখেনি। গত বছরের মতো এ বছরও পানির সংকট শুরু হয়ে গেছে। পানির অভাবে আমাদের মরতে হবে।'

পাড়ার আরেক বৃদ্ধ মেননু ম্রো (৬২) বলেন, 'এখনো শুষ্ক মৌসুম পুরোপুরি শুরু হয়নি। অথচ এখন থেকেই পাড়ার নারীদের অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে শুধু পানি সংগ্রহ করতেই দিনের বেশি সময় দিতে হয়। পাড়ায় ২৮টি পরিবার থাকে। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত, অর্থাৎ বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আমরা পানির তীব্র সংকটে থাকি। এখানে সংরক্ষিত পানি বড়জোর একমাস ব্যবহার করতে পারব।'

তিনি বলেন, 'মার্চের শুরু থেকেই আমাদের পানি সংকট শুরু হয়। পানির অভাব থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ২-৩ মাস নিয়মিত গোসল করা যায় না। যারা জুমের কাজে যায়, তারা যেখানে পানি পায় সেখানেই গোসল করে বাড়িতে ফেরে। এই অবস্থা চলতে থাকলে পানি সংকটের কারণে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।'

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

তিনি জানান, গত বছর চিম্বুক পাহাড়ে পানির সংকটের কথা শুনে সাবেক জেলা প্রশাসক ইয়াসিন পারভীন তীবরীজী সেখানে গিয়ে বাঁধ দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা বাঁধ নির্মাণের জন্য জায়গা পর্যন্ত মেপে যান। কিন্তু বছর পার হয়ে গেলেও এর কোনো অগ্রগতি নেই বলে অভিযোগ করেন পাড়াবাসীরা।

এ বছর চিম্বুক পাহাড় এলাকায় মেনলুং পাড়া, বাগান পাড়া, রামারি পাড়া, রিয়ামনই পাড়া, মেনসিং পাড়া, ক্রাপু পাড়া, দলিয়াম পাড়া, এনরা পাড়া, বাবলা হ‍েডম‍্যান পাড়া, পাতুই পাড়া, ম্রলং পাড়াসহ মোট ২৮টি পাড়ায় অন্তত ৮০০টি ম্রো পরিবার পানি সংকটে পড়েছে।

ম্রলং পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাংয়ং ম্রো ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পানি সংকটের কারণে পাড়ার শিশুরা স্কুল ছুটির পর ঠিকভাবে গোসল করতে পারছে না। ফলে বাচ্চাদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।'

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

বান্দরবান-চিম্বুক রোডের ৬ মাইল এলাকার বেথানী পাড়ার বাসিন্দা ক্লারিস বম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা এখন পানির চরম সংকটে আছি। খাবারের পানি সংগ্রহ ও গোসলের জন্য এক-দেড় ঘণ্টার পথ ধরে পাহাড়ের অনেক নিচে ঝিরিতে নামতে হয়। প্রতিদিন পানীয় জল কিনে খেতে হচ্ছে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।'

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার
 
এদিকে, জেলা সদর উপজেলার ২ নম্বর কুয়াহালং ইউনিয়নের গুংগুরু আগা পাড়ায় গিয়েও পানির তীব্র সংকটের চিত্র দেখা গেছে। পাড়ায় ১৮টি পরিবারের বসবাস। পাড়াবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পাড়ায় একটি নলকূপের ওপর নির্ভরশীল পুরো পাড়াবাসী। সকাল থেকে খাবার পানি, গোসলসহ গৃহস্থালী সব কাজের জন্য পানি সংগ্রহে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পাড়ার আশপাশে কোনো ঝিরি-ঝর্ণা কিংবা পানির উৎস নেই।

তারা জানান, ঝিরি-ঝর্ণা সব শুকিয়ে গেছে। প্রতিবছর মার্চের মাঝামাঝি নলকূপ থেকেও আর পানি পাওয়া যায় না। পানির অভাবের কারণে পাড়ার পাশেই অনাবাদী পড়ে আছে ধানের জমি।

ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

এ বিষয়ে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপ কুমার দে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ঝিরির পাশের তথা পানির উৎসের পাশের গাছ কেটে ফেলার কারণে ঝিরি-ঝর্ণার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, পানির লেয়ার মাটির অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় পাহাড়ে তাড়াতাড়ি পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে মাটির গর্ভে পাথর থাকায় গভীর নলকূপ বসানোর মত সুযোগ নেই।'

'তবে পাহাড়ের ঝিরিতে বাঁধ দিয়ে পানি সংরক্ষণ করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। আগামী ১০ মার্চ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক আছে। বৈঠকে কী সিদ্ধান্ত হয় সে অপেক্ষায় আছি', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago