‘অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র প্রভাব অতিরঞ্জন নয় বরং অনেক বেশি সত্য’
ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র (১৮৬১-১৯৩০) বংশধর অনিরুদ্ধ সান্যাল যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়া শহরের একজন প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ। তিনি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র ভাই অশ্বিনী কুমার মৈত্রেয়র কন্যা ছায়া সান্যালের পুত্র কল্যাণ কুমার সান্যালের বড় ছেলে।
অষ্টম অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় নাট্যোৎসবে যোগ দিতে গত ৪ মার্চ তিনদিনের সফরে রাজশাহীতে এসেছিলেন অনিরুদ্ধ সান্যাল। এসময় তিনি রাজশাহীর ইতিহাসপ্রেমী ও সাহিত্য অনুরাগীদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হন।
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র অমর কীর্তি বরেন্দ্র যাদুঘর, নগরীর পাঠান পাড়া, মিয়াপাড়া ও ঘোড়ামারায় বাপ-দাদার ভিটা পরিদর্শন করেন এবং ৬ মার্চ রাজশাহী ত্যাগ করেন তিনি।
গত ৫ মার্চ রাজশাহীর ঘোড়ামারা এলাকায় বইয়ের দোকান বাতিঘরে দ্য ডেইলি স্টারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অনিরুদ্ধ সান্যাল।
ডেইলি স্টার: আপনার সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানতে চাই...
অনিরুদ্ধ সান্যাল: আমি কলকাতা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। সেখানে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে মাস্টার্স, ডালাসের সাউদার্ন ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি করে কর্মজীবন শুরু করি।
আমি যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে বর্তমানে একটি ব্যাংকে কর্মরত আছি। শখের বশে আমি তথ্যচিত্র নির্মাণ করি।
ডেইলি স্টার: তথ্যচিত্র নির্মাণের শখ কতটা বিস্তার লাভ করেছে?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: ২০ বছর আগে আমি ইংল্যান্ডে কাজ করতে যাই। আমি জানতাম যে, ভারতীয় সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলে মারা গেছেন। ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের সমাধি দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। কারণ রামমোহন রায়ের মাপের মনীষীর সমাধি দেখাশোনা করছেন সেখানকার ইংরেজরা।
আমার খুব লজ্জা হলো যে, সেখানে ভারতীয় বা বাংলাদেশিদের কারও দেখা নেই। রাজা রামমোহন রায়কে সমাহিত করা হয়েছিল। কারণ সেই সময় হিন্দুমতে দাহ করাটা ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল। রামমোহন রায়ের শিষ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনিও ইংল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। তাকেও অন্য একটা সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়েছিল। আমি পরে রামমোহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুরের চরিত্রের ওপর দুটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলাম।
ডেইলি স্টার: যুক্তরাষ্ট্রে বসে কীভাবে জানলেন যে, রাজশাহীতে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে নিয়ে চর্চা হচ্ছে?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: ইতিহাসের গতি খুব ধীর। কিন্তু কখনো আবার খুব দ্রুত চলে। যেমন গত দু-তিন বছরে ঘটেছে।
আমি আসলে গত দশ বছর ধরে আমার বাবার মামাবাড়ি, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও অশ্বিনী কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কে খোঁজ-খবর চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বছর দুয়েক আগে আমি জানতে পারলাম, রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘরের কর্মকর্তা আব্দুল কুদ্দুসের কাছে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কে তথ্য আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার শফিকুল ইসলাম অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে নিয়ে অনানুষ্ঠানিক গবেষণা করছেন। তিনি একটি বই লিখছেন। মূলত তিনি তার বইটি লিখতে গিয়ে আমাদের খুঁজে বের করেছেন। তার কাছ থেকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, আমার বাবা ও মামাদের সম্পর্কে এত তথ্য পেয়েছি, যা আমাদের অজানা ছিল।
এর আগে, আমি নিউইয়র্কে বা যেখানেই কোনো রাজশাহীর বাসিন্দা পেয়েছি, তার কাছে জানতে চেয়েছি যে, তিনি অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে চেনেন কি না। কেউই কিছু বলতে পারেননি। তাকে নিয়ে যে ধরনের চর্চা হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
ডেইলি স্টার: অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে নিয়ে আপনাদের পরিবারের সদস্যরা কতটা চর্চা করেন?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: পরিবারে আমরা তিনজন তাকে নিয়ে চর্চা শুরু করেছি। আমি অক্ষয়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতার বংশ। আমি তাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
অন্যদের মধ্যে অভিজিৎ কুমার মৈত্রেয় ও সুমাল্য কুমার সরাসরি অক্ষয় কুমারের বংশধর। তারাও অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়কে নিয়ে পশ্চিম বাংলায় কাজ করছেন।
পরিবারে আমরাই প্রথম অক্ষয়কে নিয়ে কাজ করছি। এ ছাড়া, অশ্বিনী কুমারের কনিষ্ঠ পুত্র দেব কুমার মৈত্রেয় ১৯৭৯-৮২ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে ভারতের অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশনার ছিলেন। দেব কুমারের বড় ভাই সুশীল কুমার মৈত্রেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে এসেছিলেন।
ডেইলি স্টার: আপনাদের পরিবারের কাছে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কে কোনো দলিল সংরক্ষিত আছে?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ইউনিভার্সিটি অব বার্কলিতে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, দ্য ১৯৪৭ পার্টিশন আর্কাইভস। তারা আমার বাবার দুই ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে রাজশাহী, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র কথা এসেছে। এ ছাড়া, আমার ঠাকুমা ছায়া মৈত্রেয়র কিছু মোশন পিকচার আমার কাছে আছে।
ডেইলি স্টার: এতদিন পরে রাজশাহীতে এসে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: এতদিন আমাদের একটি মানসিক বাধা ছিল। আমাদের মনে হতো যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের বাড়িঘর ওখানে- বাংলাদেশে, সেখানে যাওয়া সম্ভব না। আমি এখানে আসতে পেরেছি, তাতেই আমার পরিবারের সবাই আশ্চর্য।
আমার বাবা কল্যাণ কুমার সান্যাল এখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। আগের দিনে মেয়েরা সন্তানসম্ভবা হলে বাবার বাড়ি যেতেন। আমার ঠাকুমা তেমনি এখানে তার বাবার বাড়িতে এসেছিলেন। এই মার্চ মাসেই আমার বাবা জন্মেছিলেন, মৃত্যুও এই মাসে। আমি সেই মাসেই আসতে পেরেছি। আমি বাবার জন্মস্থানের বাড়িটি পরিদর্শন করলাম। এখনকার বাসিন্দারা আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এই তথ্যগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন প্রকাশ করছি, তখন পরিবারের অন্য সদস্যরা উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন, তারা বলছেন এটা অদ্ভুত ব্যাপার। তারা পশ্চিম বাংলায় থাকেন, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসে বাপ-দাদার ভিটে দেখে যেতে পারেননি। আমি থাকি সুদূর আমেরিকায়।
ডেইলি স্টার: এখানে নতুন কোনো তথ্য পেয়েছেন?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। কারণ তার সম্পর্কে আমি এতদিন শুধু শুনে এসেছি— বাবার বড় দাদু ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন। এখন পুরো চিত্রটা আমার সামনে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
ডেইলি স্টার: কী ধরনের চিত্র দেখতে পেলেন?
অনিরুদ্ধ সান্যাল: আমি যেটা দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। আমি মনে করতাম, পরিবার থেকে যা শুনেছি তার সবকিছু ছিল অতিরঞ্জিত। কারণ দেশভাগের পর ওপারে যারা চলে গেছেন তারা গর্ব করে বলে থাকেন যে, এপারে তাদের অনেক জমিদারি ছিল, প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। আমি এসে দেখার পর আমার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। আমি জানলাম অতিরঞ্জন নয় বরং তারচেয়ে বেশি সত্য। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র বিশাল ব্যাপ্তি সত্য। তিনি এত বড় নায়ক ছিলেন যে, আজও তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
Comments