সুগত বসুর স্মৃতিচারণায় মুক্তিযুদ্ধ

অধ্যাপক ড. সুগত বসু। ছবি: স্টার

'মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম দশম শ্রেণির ছাত্র। দেখেছি নেতাজী ভবনের নিচতলায় শরণার্থী শিবিরে পাঠানোর জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধে ট্রাংক বোঝাই করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা ডা. শিশির কুমার বসু নেতাজী ভবনের নিচ তলা ছেড়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের জন্য ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহের জন্য। সেখানে বিপ্লবী বীণা দাস ভৌমিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে নানা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। একাত্তরের পুরোটা সময় নেতাজী ভবন হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কর্মযজ্ঞের এক প্রাণকেন্দ্রে।'

গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি অনুষ্ঠানে এমন করেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন অধ্যাপক সুগত বসু।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুগত বসুর আরেকটি বড় পরিচয় তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও শরৎচন্দ্র বসুর পৌত্র।

২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে 'মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও স্মৃতি সংরক্ষণ' শীর্ষক অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্মারক বক্তৃতা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে গতকাল সকালেই ঢাকায় আসেন সুগত বসু।

এবারের স্মারক বক্তা অধ্যাপক সুগত বসু-- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ প্রচার হয়েছিল এ বার্তা। ফলে তার বক্তব্য শুরুর আধ ঘণ্টা আগেই পুরো জাদুঘর মিলনায়তন টইটম্বুর।

প্রথমেই কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা। বেলা ৪টা নাগাদ বক্তব্য দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয় সুগত বসুকে।

 ১৯৭২ সালের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে এক অ্যাম্বুলেন্স বোঝাই ওষুধপত্র নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন শিশির কুমার বসু। সেই সফরে ১৭ জানুয়ারি ধানমণ্ডির বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিশির কুমার বসুর সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিশির কুমার বসুর সেই সাক্ষাৎ নিয়ে ২৩ জানুয়ারি নেতাজী ভবনে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন শিশির কুমার বসু। বক্তব্যের শুরুতেই সুগত বসু তার বাবার সেই বক্তব্যের অডিও রেকর্ড বাজিয়ে শোনান।

সুগত বসুর অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যের অনেকটা জুড়েই ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার নিজের এবং তার মা কৃষ্ণা বসুর স্মৃতিচারণা।

সুগত বসু বলেন, '১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের খবর এবং তার পরম্পরা আমাদের আলোড়িত করেছিল। ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমরা রেডিওতে শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আমার মায়ের একাত্তরের ডায়েরির ৮ মার্চ তারিখে লেখা আছে পূর্ব বাংলার বিদ্রোহের খবরে উত্তেজিত বোধ করছি।'

মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে সুগত বসু বলেন, 'এপ্রিল মাস থেকেই নেতাজি ভবনে আসতে শুরু করেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত এমএলএ, দুজন ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজসহ অগণিত গৃহহারা বাংলাদেশি। আমার মা ডায়েরিতে লিখেছেন, 'অনেক অচেনা মুখ চোখে ভাসছে। কুষ্টিয়া থেকে আসা পাঁচটি ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা দুজন ছাত্র। সকলে হতাশ ও ক্লান্ত মুখে বসে আছে। আমি তাদের ডেকে নিয়ে নেতাজী মিউজিয়াম দেখালাম। তারা যেন জেগে উঠলো। তারা বললো আমরা খুব অনুপ্রেরণা বোধ করছি। আমাদের ক্লান্তি কেটে গেছে।'

মুক্তিযুদ্ধে নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালের কার্যক্রম সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিশির কুমার বসু বলেন, 'মে মাসে বনগাঁ সীমান্তের কাছে বকচরা গ্রামে শিশির কুমার বসু প্রতিষ্ঠা করলেন নেতাজী ফিল্ড হাসপাতাল। সেখানে সত্যেন বসু রায়ের নেতৃত্বে কলকাতার শল্য চিকিৎসকেরা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রোপচার ও শুশ্রূষা করতেন। অর্থপেডিকসের দিকটা দেখতেন অশোক সেন গুপ্ত। তখন স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি। আমি বাবার সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকায় যেতাম। কলকাতায় বড় হওয়ার কারণে দারিদ্র্য দেখে অভ্যস্ত। তবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে যে দুর্দশা আমি দেখেছিলাম তা আগে কখনো প্রত্যক্ষ করিনি। বাবা ও বাবার প্রাক্তন ছাত্র উমা শংকর সরকার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেন উদ্বাস্তু শিশুদের চিকিৎসা করতে। নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালে বাড়ির ভেতরে ২৫টি বেডের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। বাইরে বাগানে তাঁবু খাটিয়ে আরও কিছু আহত সৈনিকের শুশ্রূষা করা যেত। স্যালাইনের অভাব পড়লে কচি ডাবের জল দিয়ে কাজ চালানো হতো। মা যেতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে। যুদ্ধচলাকালীন শিশির কুমার বসু ও তার সহকর্মীরা যশোর ও খুলনা হাসপাতাল অব্দি গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালে আনা হতো।'

নিজের প্রথম বাংলাদেশ সফরের বর্ণনা দিতে গিয়ে সুগত বসু বলেন, 'একাত্তরের নভেম্বরের শেষ রবিবার, বাবার সঙ্গে নেতাজী ফিল্ড হাসপাতালে গিয়েছি। দিনের শেষে বাবা বললেন, সীমান্তের অবস্থা একটু দেখে আসা যাক। আমাদের জিপ যশোর রোড ধরে ছুটে চলল। একটি কালভার্টের কাছে গতি কমাতেই কয়েকজন বন্ধুত্বপূর্ণ সেনা বললেন, আমরা নো ম্যানস ল্যান্ডস পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছি। সামনে বিপদ হতে পারে, এবার ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। পাসপোর্ট এবং ভিসা ছাড়া সেটাই আমার বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ।'

ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের বিষয়ে বলতে গিয়ে সুগত বসু বলেন, 'আমার মা ছিলেন লক্ষ্মীবাজারের সন্তান। স্বাধীনতার পরে মা লক্ষ্মীবাজারের কথা জিজ্ঞেস করায় বন্ধুরা বলেছিলেন লক্ষ্মীবাজার আছে, আমরা অলক্ষ্মী নিয়ে থাকব নাকি!'

কেবল মুক্তিযুদ্ধই নয়, সুগত বসুর দেয়া বক্তব্যে একই সঙ্গে উঠে আসে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসুর নানান তৎপরতা প্রচেষ্টা, চিত্তরঞ্জন দাশের বেঙ্গল প্যাক্ট প্রসঙ্গ, শরৎচন্দ্র বসুর অখন্ড বাংলার প্রচেষ্টা, দেশভাগ, বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে সত্তরের দশকে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার সাক্ষাৎসহ নানা বিষয়।

অনুষ্ঠানে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা 'ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা' গান গেয়ে বক্তব্য শেষ করেন সুগত বসু।

অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সরওয়ার আলী ও মফিদুল হক। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিগত এক বছরের কর্মকাণ্ড ও নানা উদ্যোগের কথা পড়ে শোনান জাদুঘরের ট্রাস্টি সারা যাকের। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন ট্রাস্টি মফিদুল হক।

অনুষ্ঠানের শেষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে কয়েকটি ঐতিহাসিক স্মারক প্রদান করেন সুগত বসু।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

6h ago