চট্টগ্রামে বেসরকারি চিকিৎসকদের ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘট, ভোগান্তিতে রোগীরা

‘চিকিৎসকরা কিছুদিন পর পর ধর্মঘটের নামে রোগীদের জিম্মি করে তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করেন। পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে এমন নজির নেই।’
চট্টগ্রাম নগরীর একাধিক হেলথকেয়ার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে ধর্মঘট পালনের ব্যানার ঝুলিয়ে রাখতে দেখা গেছে। ছবি: স্টার

চট্টগ্রামে চিকিৎসক সংগঠনগুলোর আহ্বানে চলমান ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটের কারণে আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বিভিন্ন টেস্টের জন্য আসা রোগীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

ধর্মঘট চলাকালে বেসরকারি ক্লিনিকে নতুন কোনো রোগী ভর্তি না করায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ দিনের তুলনায় রোগীদের ব্যাপক ভিড় লক্ষ করা গেছে।

ধর্মঘট পালনের অংশ হিসেবে চিকিৎসকরা তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারেও আজ কোনো রোগী দেখছেন না।

বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসকরা আল্ট্রাসনোগ্রাম, এন্ডোস্কোপি, কোলনোস্কোপি এবং মাইক্রোস্কোপিক প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা না করায় জরুরি রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন।

এমনকী, বেশিরভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের প্যাথলজিক্যাল এবং মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য নাম তালিকাভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

তামান্না বিনতে করিম আজ ভোরে এপিক হেলথকেয়ারে এন্ডোস্কোপি করতে আসেন, কিন্তু তাকে পরীক্ষা না করেই ফিরে যেতে হয়।

সাতকানিয়া থেকে আগত তামান্না বলেন, 'আমি গ্যাস্ট্রাইটিসের রোগী। ডাক্তার দেখানোর জন্য শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেছি। রোববার চেম্বারে ডাক্তার দেখিয়েছি। তিনি আমাকে পেটের এন্ডোস্কোপিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। ভেবেছিলাম আজ পরীক্ষাগুলো করে সন্ধ্যায় ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখিয়ে আগামীকাল বাড়িতে চলে যাব। বাড়িতে ছোট বাচ্চা রেখে এসেছি শাশুড়ির কাছে।'

তামান্না জানান, চিকিৎসকদের ধর্মঘটের বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না।

এ বিষয়ে জানতে এপিক হেলথকেয়ার প্রাইভেট লিমিটেডের ব্র্যান্ড ম্যানেজার জহির রায়হানকে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

পটিয়া জেনারেল হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রক্তিম দাশের ওপর রোগীর স্বজনদের হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার এবং নগরীর মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. রিয়াজ উদ্দিন শিবলুকে মারধরের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের জামিন বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ), বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদসহ চট্টগ্রামে চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো আজ ভোর ৬টা থেকে আগামীকাল বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘট আহ্বান করে।

ধর্মঘটের অংশ হিসেবে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো কোনো নতুন রোগীকে ভর্তি বা নথিভুক্ত করছে না, আর চিকিৎসকরা বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং তাদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখছেন না।

চিকিৎসক সংগঠনগুলো ধর্মঘট পালন করায় আজ বেশিরভাগ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ থাকতে দেখা যায়। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় রোগীদের।

দুপুরে জামাল খান এলাকায় অবস্থিত সেনসিভ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ইনোভা হসপিটাল লিমিটেডের প্রধান প্রবেশদ্বার বন্ধ দেখা যায়। প্রবেশদ্বার থেকে অনেক রোগীকে ফিরে যেতে দেখা গেছে। সেনসিভ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এক নিরাপত্তারক্ষী বলেন, 'কোনো রোগীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।'

ন্যাশনাল হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, সিএসসিআর প্রাইভেট লিমিটেড, শেভরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ম্যাক্স হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার হাসপাতাল এবং মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে একই পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা গেছে।

গুরুতর অসুস্থ সুপ্তি বড়ুয়াকে স্বজনেরা নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকার পার্কভিউ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে স্বজনেরা তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান।

সুপ্তি বড়ুয়ার কাকা হিমেল বড়ুয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'চিকিৎসকরা কিছুদিন পর পর ধর্মঘটের নামে রোগীদের জিম্মি করে তাদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করেন। পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে এমন নজির নেই।'

যোগাযোগ করা হলে পার্কভিউ হাসপাতাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, 'হাসপাতালে নতুন কোনো রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না এবং হাসপাতালের পরীক্ষাগারে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার জন্য কোনো রোগীকে তাদের নাম নথিভুক্ত করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।'

'আমরা জরুরি রোগীদের চমেক হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি', বলেন তিনি।

এ বিষয়ে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, 'যেহেতু প্রাইভেট হাসপাতালগুলো রোগী গ্রহণ করছে না, তাই চমেক হাসপাতালের আউটডোর এবং ইনডোরে রোগীদের ভিড় খুব বেশি।'

'সাধারণত চমেক হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ৯০০ রোগী ভর্তি হয়, তবে আজ সংখ্যাটি এক হাজার ২০০-তে পৌঁছেছে। আমাদের ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা রোগীদের অতিরিক্ত চাপ সামাল দিতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন', যোগ করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো তাদের ওপর ধর্মঘট 'চাপিয়ে দিয়েছে'।

এ বিষয়ে বিএমএ চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক ডা. ফয়সাল ইকবাল চৌধুরী বলেন, 'ডাক্তার, প্রাইভেট ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিকিৎসক সংগঠনের আহ্বানে ধর্মঘট পালন করছে।'

'হাসপাতালে চিকিৎসকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আমরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছি', বলেন তিনি।

Comments