তাপদাহের মধ্যে যন্ত্রের মতো চলছে ট্রাফিক পুলিশের রক্ত-মাংসের জীবন

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১১টা। প্রচণ্ড রোদে যখন রাজধানীবাসী অস্থির, তখন শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন মোহাম্মদ শামীম।

তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে তখন রাস্তায় ছিল গরম বাতাস। অনেক যানবাহন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল। ধুলাবালি আর গাড়ির কর্কশ হর্নের মধ্যে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলেন তিনি।

কষ্ট হলেও দায়িত্ব পালনে অবহেলা দেখা যায়নি শামীমের মধ্যে। গাড়ির এত চাপ যে, একটু অন্যদিকে মনোযোগ সরালে রাস্তায় সৃষ্টি হয় যানজট।

যন্ত্রের মতো বিরতিহীনভাবে চলছে তার রক্তে-মাংসের জীবন।

ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা টানা আট ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাকে। এই অস্থির গরমের মধ্যে মাথার উপর বড় ছাতা একমাত্র ভরসা। রোদ কিংবা বৃষ্টি—যেকোনো পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করতে হয় শামীমকে।

শুধু মোহাম্মদ শামীমই নন, তার মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করছেন, তাদের প্রায় সবার প্রতিদিনের জীবনের বাস্তবতা একই।

মোহাম্মদ রুস্তম আলী (৫২) গত ৩২ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছেন। শ্যামলীতে শিশুমেলার সামনে দায়িত্বরত অবস্থায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রচণ্ড রোদে ছাতা দিয়েও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। ছাতা দিয়ে বৃষ্টি প্রতিরোধ করা যায়, গরম রোধ করা যায় না। শরীরে আর সহ্য হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত ঘামে ভিজে যাচ্ছি। সর্দি, মাথাব্যথা শুরু হয়। গত দুই দিন আগে লুজ মোশন হয়।'

'এই তাপদাহের মধ্যে দায়িত্বপালন করা খু্বই কঠিন। পরিবার থেকে বারবার অনুরোধ করেছে যেন, নিজেকে সেভ করে দায়িত্ব পালন করি। ছেলে-মেয়েরা আমাকে নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন', বলেন তিনি।

রাজধানীর কাঁটাবন, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি ও শিশুমেলার সামনের ট্রাফিক পুলিশসহ অন্তত ১৫ জন দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন আনসার সদস্যরাও।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আনসার সদস্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ট্রাফিক বিভাগে আমি ডিউটি শুরু করেছি দুই মাস হলো। এই তীব্র গরমে কাজ করে মাসে বেতন পাই ১৬ হাজার ২০০ টাকা। এটা দিয়ে ঢাকায় ফ্যামিলি নিয়ে বসবাস করা অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়েই ফ্যামিলিকে গ্রামের বাড়িতে রাখতে হয়। কষ্ট হলেও নিজের ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে।'

প্রখর রোদে দায়িত্ব পালন করছেন এক ট্রাফিক পুলিশ। ছবিটি শনিবার নূর হোসেন চত্বরের সামনে থেকে তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী এমরান হোসেন।

রাজধানীর একটি মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'এই তীব্র তাপদাহের মধ্যে আমাদের আট ঘণ্টার বেশি সময় দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। সপ্তাহে কোনো ছুটি নেই। কাজের চাপে মানসিক শান্তি অনুভব করতে পারি না। পরিবারকে সময় দিতে পারি না। আমরা খুবই অমানবিক জীবনযাপন করি। মাঝেমধ্যে নিজেকে যন্ত্র ছাড়া কিছুই মনে হয় না।'

'রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু আমাদের ডিউটি বাই-রোটেশন সিস্টেম করলে কাজের চাপ কমে আসত। তখন একটু হলেও শান্তি পেতাম', যোগ করেন তিনি।

তীব্র তাপদাহের মধ্যে যেসব ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ব্যবস্থাপনায় সুপেয় পানির সঙ্গে রয়েছে গ্লুকোজ ও খাবার স্যালাইন। কোনো কোনো জায়গায় সাধারণ মানুষের জন্যও ওয়াটার ট্যাঙ্ক রাখা হয়েছে।

তবে, পুলিশের মতো গ্লুকোজ ও খাবার স্যালাইন পাচ্ছেন না আনসার সদস্যরা। তাদের অভিযোগ, পুলিশ সদস্যরা নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত গ্লুকোজ ও স্যালাইন থেকে দিলে আনসার সদস্যরা তা খেতে পারেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারজন আনসার সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আমাদের জন্য ডিএমপি থেকে কোনো নির্দিষ্ট বরাদ্দ নেই। পুলিশদের ভাগের অংশ থেকে কেউ কেউ স্যালাইন বা গ্লুকোজ দিলে আমরা পাই। আমরাও রোদের মধ্যে পুলিশের মতো সমান কষ্ট করি।

শাহবাগ ট্রাফিক জোনের সহকারী সাব-ইনস্পেক্টর শফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তাপদাহের কথা বিবেচনা করে ডিএমপি স্যালাইন, গ্লুকোজ ও পানির ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়াও, ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তুলনামূলক কম ব্যস্ত সড়কে।'

জানতে চাইলে বাংলামোটর মোড়ে দায়িত্বরত সার্জেন্ট শফিউল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডিএমপির পক্ষ থেকে খাবার স্যালাইন ও গ্লুকোজ আনসার সদস্যদের জন্যও রাখা আছে। প্রয়োজনমতো তারাও তা পাচ্ছেন।'

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পেশাদারিত্ব ও ডেডিকেশন দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ এবং তাদের সঙ্গে আনসার সদস্যরা চলমান তাপদাহের মধ্যে কাজ করছেন। আমরা তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দায়িত্ব পালন করতে নির্দেশনা দিয়েছি।'

আনসার সদস্যদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এমন হওয়ার কথা নয়। ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে আনসার সদস্যরা কাজ করছেন। তাদের জন্যেও স্যালাইন ও গ্লুকোজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরপরও অভিযোগটি খতিয়ে দেখা হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Tk 2,956 crore earmarked for Election Commission

Of this amount, Tk 2,727 crore has been allocated as revenue budget, while Tk 229 crore was allocated as development budget

48m ago