সড়ক দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত ‘হত্যা’

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যত ধরনের অনিয়ম হতে পারে, তার সবই আমাদের দেশে হয়। এর পেছনে মূল কারণ, ঘুষের জাদুকরি প্রভাব। আইন, নীতিমালা, সরকারি নির্দেশনা—সবকিছুর ঊর্ধ্বে কাজ করে ‘ঘুষের আইন’। এটা আইনের বইয়ে লিখিত যেকোনো ধারার চেয়ে বেশি উপযোগী, দ্রুত ও কার্যকর।

মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়েছে—এটা তখনই বলা যায়, যখন এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক ও অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও সেটি ঘটে। কিন্তু দেশের সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রতিটি আনাচে-কানাচে এ ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে এবং এ বিষয়ে বছরের পর বছর সরকারি তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ, জনসাধারণের ক্ষোভ ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থাকলে, সেটাকে আর 'দুর্ঘটনা' বলা যায় না। বরং সেটা হয়ে যায় অবহেলাজনিত 'হত্যা'।

আইন অনুযায়ী এগুলো প্রতিহত করার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই এর জন্য দায়ী। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদেরকে এ ধরনের গুরুতর অবহেলার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা উচিত। দেশে যদি স্বাধীনভাবে আইনের শাসন প্রচলিত থাকত, তাহলে সেটা সম্ভব হতো।

গত ১৫ মার্চ মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় যে বাসটি ১৯ জনকে 'হত্যা' ও ২৫ জনকে আহত করেছে, সেটি এই ঘটনার মাত্র ৪ মাস আগে নভেম্বরে ৩ জনকে 'হত্যা' ও অনেক মানুষকে আহত করেছিল। ওই ঘটনার পর বাসটির নিবন্ধন ও রুট পারমিট স্থগিত করা হয়। বাসটিকে আরও আগেই সড়ক থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশের জিম্মায় রাখা উচিত ছিল, সাধারণত যেটি করা হয় মারাত্মক দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত যেকোনো যানের ক্ষেত্রে। অথচ, এই বাসটি যে শুধু মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাই নয়, নিয়মিতভাবে সড়কে চলতেও দেওয়া হয়েছে।

যারা এই ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন তারা জানান, যাত্রার শুরু থেকেই বাসটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলছিল এবং যাত্রীরা বারবার চিৎকার করে চালককে আস্তে চালাতে বলেছিলেন। কিন্তু তা না করে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর চালক গতি আরও বাড়িয়ে দেন। কারণ বেশি ট্রিপ দিতে পারলে তার বাড়তি আয় হবে। যাত্রীর জীবন নিয়ে কে ভাবে? ঘুষ দিলেই তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

যতবারই সড়ক-মহাসড়কে কোনো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, ততবারই আমরা প্রতিবেদন করি, যানবাহনগুলোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। এমনকি, সড়কে চলাচলে যোগ্যতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি 'ফিটনেস সনদ'ও নেই। আমাদের প্রতিবেদনে এটাও উঠে আসে যে ফিটনেস সনদ দেওয়া জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও যন্ত্রের অপ্রতুলতা রয়েছে। বর্তমানে দেশে মাত্র একটি পরিবহন পরিদর্শন কেন্দ্র (ভিআইসি) রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে ১০০টি বাস ও ট্রাক পরিদর্শন করা হয়। অথচ, বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে অন্তত ২ লাখ ২৯ হাজার ৩৬৯টি বাস, ট্রাক ও মিনিবাস রয়েছে।

কেন এই সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে না? কেন দেশজুড়ে আরও পরিদর্শন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে না? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমরা পাই না। এটা বলা নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের দেশের সড়কে চলাচল করা বাসগুলোর বেশিরভাগই সম্ভবত যাত্রী পরিবহনে 'আনফিট' এবং প্রতিটি বাসই 'মৃত্যুদূত' হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, নিশ্চিতভাবেই ঘুষ সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে।

আমাদের প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে, অন্তত গত ১ দশক যাবৎ বাস চালাচ্ছেন এমন বেশিরভাগ চালকের লাইসেন্স নেই। যাদের আছে, তাদের ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ লাইসেন্স 'ভুয়া'। কারণ, এ ধরনের ভুয়া লাইসেন্স দ্রুত ও সহজে পাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য, আসল লাইসেন্সের চেয়ে ভুয়া লাইসেন্সের খরচও অনেক কম।

আবারও বলতে হয়, সবক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন হচ্ছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেন হচ্ছে না? এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই। হয়তো আমরা ঘুষের জাদুকরি ক্ষমতার কথা ভুলে যাচ্ছি।

বেশিরভাগ চালকের শুধু গাড়ি চালানোর প্রাথমিক জ্ঞান রয়েছে। বৃষ্টির সময় পিচ্ছিল সড়কে গাড়ি চালানোর বিষয়ে কোনো জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ সম্ভবত তাদের নেই। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার এই দেশে এ ধরনের প্রশিক্ষণ না নিয়ে গাড়ি চালানোর অর্থ 'দুর্ঘটনা'কে আমন্ত্রণ জানানো।

আমরা বাসের চেসিস আমদানি করি। বডি, সিট, নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ বাসের বাকি অংশ দেশেই সংযুক্ত করা হয়। এগুলো সূক্ষ্ম কারিগরি জ্ঞান-নির্ভর একটি বিষয়। কারণ উপকরণের সক্ষমতা, বহনক্ষমতা, বক্র পথে চলার সময় মূল কাঠামোর ওপর প্রভাব, বিশেষত যখন বাস যাত্রীতে পূর্ণ থাকে, চলমান অবস্থায় গতি ও ওজনের অনুপাত, যাত্রী পূর্ণ থাকা অবস্থায় হঠাৎ ব্রেক করলে চাকার ওপর প্রভাব, সর্বোচ্চ যাত্রী ধারণ ক্ষমতা—সবই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা বাসগুলো নির্মাণ করেন, তারা কি এসব বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন? বাস নিবন্ধনের সময় কোন বিষয়গুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে? যারা এসব বাধ্যবাধকতার নজরদারি করেন, তারা কি যথাযথ প্রশিক্ষণ পেয়েছেন?

চালকদের 'স্বাস্থ্য পরীক্ষা'র কোনো অস্তিত্ব নেই, বিশেষত তাদের দৃষ্টিশক্তির। চালকদের চশমা প্রয়োজন কি না, তা দেখা হয় না। যারা রাতে গাড়ি চালান, তাদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দৈবচয়নের ভিত্তিতে করা সমীক্ষায় জানা গেছে, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরও বেশি চালকের চশমা প্রয়োজন এবং তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ধরনের রাত্রিকালীন দৃষ্টিশক্তি সমস্যায় ভোগেন।

এরপর আসে আমাদের বাস চালকদের কর্মঘণ্টার বিষয়টি। তাদের বাধ্যতামূলক বিশ্রামের সময় বলে কিছু নেই বললেই চলে। প্রায়ই চালকরা চলন্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েন। কারণ, বাস মালিকরা বাড়তি চালক রেখে জীবন বাঁচানোর চেয়ে 'ওভারটাইম' দেওয়াকে সুবিধাজনক মনে করেন। আমরা এমনও ঘটনা দেখেছি, চালকের পরিবর্তে হেলপার বাস চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যত ধরনের অনিয়ম হতে পারে, তার সবই আমাদের দেশে হয়। এর পেছনে মূল কারণ, ঘুষের জাদুকরি প্রভাব।

আইন, নীতিমালা, সরকারি নির্দেশনা—সবকিছুর ঊর্ধ্বে কাজ করে 'ঘুষের আইন'। এটা আইনের বইয়ে লিখিত যেকোনো ধারার চেয়ে বেশি উপযোগী, দ্রুত ও কার্যকর।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাস ও ট্রাকের আকার ও ট্রিপের সংখ্যার অনুপাতে মাসিক 'ফি' আদায়ের জন্য একটি মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যক্রম চালু আছে। এই 'ফি' দেওয়া বাস ও ট্রাকের মোবাইল নম্বর ১টি 'মোবাইল অ্যাপ'র মতো কিছুতে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। সেখানে পেমেন্টের বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এবং শহরের যেকোনো জায়গায় নিযুক্ত ট্রাফিক কর্মকর্তারা তা যাচাই করতে পারেন। অর্থাৎ, কেউ ফি না দিলে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং সে অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থাও করা যায়। ডিজিটাল মাধ্যমে এই ফি আদায় করা হয় এবং সংস্থার বিভিন্ন পদ অনুযায়ী তা বণ্টন করা হয়।

এ ধরনের বড় আকারে বিস্তৃত ঘুষের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণ আইনি অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দেয় এবং এ কারণেই মূলত গত কয়েক দশকের সরকারি তদন্ত ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকৃত সত্য উন্মোচিত হলেও কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। বাস মালিকদের আইনভঙ্গের ঘটনা যত বেশি বাড়ে, ততই দৃঢ় হয় তাদের ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চাপ এবং সেই অনুযায়ী ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও বাড়তে থাকে।

পরিণামের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য পরিবহণ মালিক গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'কাগজ থাকুক আর নাই থাকুক, আমাদেরকে ঘুষ দিতেই হয়। তাহলে কেন আর কাগজ করতে যাব? এর জন্য তো আবার সরকারি ফিসহ আরও ঘুষ দিতে হবে?' এ ধরনের ঘুষের নেটওয়ার্কের বিষয়টি সবারই জানা। এখানে ক্ষমতার কাঠামো এমন যে সরকারই বিষয়টিকে অবজ্ঞা করতে পছন্দ করে।

কোনো বাসে উঠলে সবচেয়ে অস্বস্তিকর হচ্ছে, যাত্রী হিসেবে আমাদের যে মৌলিক অধিকার—সেই নিরাপদ যাত্রার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। আমরা জানি না, বাসটি নিবন্ধনকৃত, নাকি অবৈধভাবে চলছে। যে বাসে উঠছি, সেটি সড়কে চলার জন্য উপযোগী কি না, তাও আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না যে চালকের বৈধ লাইসেন্স আছে কি না। আমরা তার মানসিক অবস্থা, স্বাস্থ্য, দৃষ্টিশক্তি, তিনি মাদকাসক্ত কি না—এসবের বিষয়েও জানি না। বস্তুত, আমরা কিছুই জানি না এবং ভয়ে জিজ্ঞাসও করতে পারি না। বেশি প্রশ্ন করলে বাস থেকে নামিয়েও দেওয়া হতে পারে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা গেছে, যে দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা গেছেন, ওই বাসের চালককে জানানো হয়েছিল যে বাসের ব্রেকে সমস্যা আছে এবং যেকোনো সময় বিকল হতে পারে। চালক সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকায় গিয়ে ব্রেক ঠিক করাবেন।

এসব কিছুই ঘটছে এবং বছরের পর বছর ধরে ঘটছে। কারণ, আমাদের শাসকরা (সব সরকারের কথাই বলছি), আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার (Right to Life) নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না।

যাত্রীর অধিকার রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে ২৮ হাজার ২৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯ হাজার ৫২২ জন নিহত ও ৫৮ হাজার ৭৯১ জন আহত হয়েছেন। এই সংখ্যাগুলো গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে পাওয়া গেছে। প্রত্যন্ত গ্রামীণ সড়কে নিহতের অনেক খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না। সে হিসাবে এই নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হবে। পুলিশের দাবি, একই সময়ে তাদের কাছে দায়ের করা মামলা অনুযায়ী, ২০ হাজার ৪১৩ জন নিহত ও ২১ হাজার ৬২৫ জন আহত হয়েছেন। বিভিন্ন কারণে দুর্ঘটনার পরে সবাই মামলা করেন না। এ কারণেই হয়তো পুলিশের কাছে সংখ্যাটি এত কম।

আমরা যদি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান আমলে নেই, তাহলে বছরে নিহত দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার জনে। আর পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী তা ৪ হাজারের বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরে ইউক্রেনে প্রায় ৮ হাজার সিভিলিয়ান নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়। অর্থাৎ, শান্তিতে থাকা একটি দেশের শুধু সড়কে নিহতের সংখ্যার সঙ্গে বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির তুলনা করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে এটি পরিহাসের বিষয়।

পুলিশের দেওয়া সংখ্যা আমলে নিলে নিহতের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি পরিহাসেরই থেকে যায় এবং এর মর্মান্তিকতা কমে না।

২টি বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন—মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান এবং সরকারের জবাবদিহি প্রক্রিয়া। আমরা জানি, প্রথম বিষয়টি নিয়ে অনেক লোক দেখানো কার্যক্রম হবে এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে আরও বেশি হবে। কিন্তু আমরা আমাদের কল্পজগতে থাকব এবং আরও বেশি বাংলাদেশিদের মৃত্যু হতে থাকবে। আর সেই মৃত্যু কোনো আগ্রাসনে নয়, হবে আমাদের সড়কেই।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments