মালয়েশিয়ায় নিয়োগ: রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে দেশ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার পাচার

অর্থপাচার

চার বছরের বিরতির পর ২০২২ সালের আগস্ট থেকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ যখন শুরু হয়, তখন দুই দেশের সম্মতিতে প্রতিটি নিয়োগ বাবদ প্রত্যেক কর্মীর জন্য খরচ নির্ধারণ হয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা।

কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ভেরিটের একটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়া যেতে প্রত্যেক কর্মীকে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বা ৫ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের চারজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের অবস্থা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তারা বলেছেন, প্রত্যক কর্মীকে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার ডলার খরচ করতে হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় কর্মরত কয়েকজন প্রবাসী কর্মী দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন যে, তারা ৫ লাখ টাকার বেশি খরচ করে মালয়েশিয়া গেছেন।

কর্মী নিয়োগের বিষয়ে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। সেখানে বলা হয়েছিল, একজন কর্মীকে পাসপোর্ট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিবন্ধন, কল্যাণ, বীমা, পরিচয়পত্র, অভিবাসন ছাড়পত্র, পোশাক ও নিয়োগ সংস্থার ফিয়ের জন্য ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার বেশি খরচ করতে হবে না।

কর্মীদের প্লেনের টিকিট, ভিসা, সিকিউরিটি ডিপোজিট, ইনস্যুরেন্স, মেডিকেল টেস্ট, কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ডকুমেন্ট অ্যাটেস্টেশন এবং মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্টের ফি দেওয়ার কথা মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের।

এ খাত সংশ্লিষ্টরা ও গবেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার বাছাইকৃত ১০০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সিন্ডিকেট এমন একচেটিয়া অবস্থার সৃষ্টি করেছিল যার কারণে কর্মীদের ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।

অনেকের মতে, বাংলাদেশে এই সিন্ডিকেটের হোতা ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক রুহুল আমিন স্বপন।

মালয়েশিয়ায় এই সিন্ডিকেটের নেতা দাতুক সেরি মোহাম্মদ আমিন আবদুল নুর। এই বাংলাদেশি নাগরিক পরে মালয়েশিয়ার নাগরিকত্ব নেন। তার আইটি ফার্ম বেস্টিনেট মালয়েশিয়া সরকারের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

চক্রটি পরস্পরের যোগসাজশে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছে।

বিদেশে কর্মী নিয়োগ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের কয়েকজন সংসদ সদস্য ও তাদের আত্মীয়স্বজন এবং রাজনৈতিক নেতারা এই চক্রের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে থাকেন।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ক্যাথারসিসের মালিক রুহুল আমিনকে একাধিকবার কল করা হলেও, তিনি রিসিভ করেননি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সিন্ডিকেটের সদস্যদের মালয়েশিয়ায় একজন কর্মী নিয়োগের জন্য সিন্ডিকেটের নেতাকে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা দিতে হয়। মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তাদের কাছ থেকে চাকরির চাহিদাপত্র নেওয়া মধ্যস্বত্বভোগীরা নেয় প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

সম্প্রতি এই মধ্যস্বত্বভোগীরা দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানান তারা।

মালয়েশিয়ার একটি সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, 'মালয়েশিয়া সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনও এই টাকার একটি অংশ পায়।'

জাতিসংঘের চার বিশেষজ্ঞ তাদের চিঠিতে বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুই হয় দেশটির মানবসম্পদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে। এই ঘুষ দিতে হয় 'ভুয়া নিয়োগকর্তাদের ভুয়া কোটা' পাওয়ার জন্য।

গত বছরের ১৯ অক্টোবর মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুশনের বক্তব্যের বরাতে মালয়েশিয়ার সংবাদপত্র দ্য স্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিধি শিথিল ও পুনর্নির্ধারণের কারণে উত্পাদন ও পরিষেবা খাতে আড়াই লাখের বেশি বিদেশি কর্মীকে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।'

মালয়েশিয়ার একটি সূত্রের মতে, নিয়োগকর্তাদের বিদেশি কর্মী নিয়োগদানের বিধি তাদের সরকার শিথিল করলেও, এ সুযোগে ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

সূত্রটি বলছে, প্রত্যেক কর্মী নিয়োগের জন্য মালয়েশিয়ার মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট নেতাদের জন্য দেওয়া মোট ২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বা ২ হাজার ২৬৫ ডলার বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হয়েছে।

২০২২ সালের আগস্ট থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ বাংলাদেশি কাজের জন্য মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন। সে হিসাবে এই কর্মীদের নিয়োগের জন্য সিন্ডিকেট সদস্যরা মালয়েশিয়ায় ঘুষ হিসেবে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার করেছে।

একজন রিক্রুটিং এজেন্ট দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'সিন্ডিকেট নেতাদের আয়ের একটি অংশ অন্য দেশেও পাচার হয়ে থাকতে পারে।'

আরেক রিক্রুটিং এজেন্ট জানান, আগ্রহী কর্মীরা অনেক সময় লাইসেন্সধারী এজেন্সিতে সরাসরি না গিয়ে দালালের মাধ্যমে যান। এতে তাদের আরও ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়।

ভেরিটের সমীক্ষার সঙ্গে কাজ করেছেন ডব্লিউএআরবিই ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়োগের জন্য শ্রমিকদের বেশি টাকা দিতে হলে তাদের যে ঋণ করতে হয়, নিয়মিত চাকরি করে গেলেও ২-৩ বছর ধরে সে ঋণ পরিশোধ করতে হয়।'

'আর যে শ্রমিকরা চাকরি পান না বা কম বেতনে চাকরি করেন, তাদের চরম দুর্ভোগ ও শোষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়,' বলেন তিনি।

সাইফুল হক আরও বলেন, 'অন্যদিকে, শ্রমিক নিয়োগের ফি'র একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে ঘুষ হিসেবে বিদেশে পাঠানো হয়। এভাবেই দেশ থেকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।'

জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির যুগ্ম মহাসচিব-১ মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রমে ভয়াবহ অনিয়ম পেয়ে মালয়েশিয়া ২০১৮ সালে এবং এ বছর কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে।'

২০১৬-১৮ সালে ১০ জন রিক্রুটিং এজেন্টের সিন্ডিকেট ছিল এবং এবার এজেন্ট সংখ্যা বেড়ে ১০০ হয়েছে।

প্রতি কর্মী নিয়োগে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা অতিরিক্ত ফি নেওয়ায় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মালয়েশিয়া নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করে।

ফখরুল বলেন, 'আমাদের সরকারের উচিৎ সিন্ডিকেটের এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ভেঙে ফেলার যা যা দরকার সবকিছু করা।'

সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, 'জনশক্তি এজেন্ট সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত দুর্নীতি দমন কমিশনকে করতে হবে।'

'অপরাধীদের জবাবদিহি নিশ্চিত না করে আমরা নিয়োগ খাত ঠিক রাখতে পারব না,' বলেন তিনি।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মালয়েশিয়ায় আগামীকাল থেকে বিদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh vs Vietnam RMG exports

Can Bangladesh fend off Vietnam in RMG race?

Bangladesh's limited trade diplomacy, coupled with its slower shift towards value-added production, could allow Vietnam to surpass it in global rankings

10h ago