কত ভালো লাকির ‘লাক’!

লায়লা কানিজ লাকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের স্ত্রী। কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় তার ছেলের একটি ছাগল কেনার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আলোচনায় আসেন মতিউর রহমান।

নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক লায়লা কানিজ লাকি।

একসময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রাক্তন এই শিক্ষকের নামে বিপুল সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে, যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ থেকে বোঝা যায়, কেউ তার সম্পদ লুকিয়ে রাখার নিরাপদ জায়গা হিসাবে তার নাম ব্যবহার করেছে।

লাকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য মতিউর রহমানের স্ত্রী। যিনি কোরবানির জন্য ১২ লাখ টাকায় তার ছেলের একটি ছাগল কেনার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আলোচনায় আসেন।

মতিউর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি। গ্রেড-১ চাকরিতে তার মূল মাসিক বেতন ৭৮ হাজার টাকা। তবে আজ তাকে এনবিআরের পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবর, এনবিআর সূত্র এবং দ্য ডেইলি স্টারের হাতে আসা একাধিক নথি থেকে জানা যায়, এনবিআরের এই কর্মকর্তা ও তার ঘনিষ্ঠ ও দূর সম্পর্কের পরিবারের সদস্যদের প্রচুর সম্পদ আছে। যার মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানিতে উল্লেখযোগ্য শেয়ারও রয়েছে।

মতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেননি। তবে অন্যান্য গণমাধ্যমের কাছে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

লায়লা কানিজ লাকি। ছবি: সংগৃহীত

এবারের নরসিংদী উপজেলা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া লাকির আয়কর নথিতে তার সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা দাবি করা হলেও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, তিনি তার সম্পদের পরিমাণ অনেক কম দেখিয়েছেন।

তার সম্পদের বিবরণী অনুযায়ী, ঢাকায় আট একর জমি যার বেশির ভাগ অকৃষি জমি ও পাঁচটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। যার মোট মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

সম্পদের এই তালিকায় দেখানো হয়নি রায়পুরা উপজেলার মারজাল গ্রামে তার প্রাসাদের মতো বাড়িটিও।

মতিউর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

বহুল আলোচিত ওই বাড়ি উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। আশেপাশের ঢেউটিনের ঘর আর ছোট কুঁড়েঘরের পাশে দোতলা সাদা ওই প্রাসাদোপম বাড়ি যেন সব ঐশ্বর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আর এই বাড়িতে যেতে সামনের রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে তার নামে লায়লা কানিজ লাকি রোড।

বাড়ির সামনে লাকির নিজের নামে সড়ক। ছবি: স্টার

রায়পুরা উপজেলা প্রকৌশল অফিসের শামীম ইকবাল মুন্না জানান, ২০১৪ সালে ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১২৩ মিটার সড়কটি নির্মাণ করা হয়।

কাছাকাছি মো. বশির উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ওই রাস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে স্কুলের তহবিল থেকে, লাকির টাকা দিয়ে নয়। তারা বলেন, লাকি তার প্রভাব খাটিয়ে তার নামে রাস্তার নামকরণ করেছেন।

লাকি চার বছর আগে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন এবং তার আয়কর বিবরণী অনুযায়ী তিনি বছরে মাত্র ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পেনশন পান।

তিনি তার হলফনামায় এটাও উল্লেখ করেননি যে তিনি ওয়ান্ডার পার্ক এবং ইকো রিসোর্টের অন্যতম মালিক।

ইকো রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, লাকির দুই সন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান ও ফারজানা রহমান ইপশিতা ইকো রিসোর্টের সহ-মালিক।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আলতাফ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ইকো রিসোর্টটি তার পাশের একটি কমিউনিটি কবরস্থানের কিছু অংশের জমি দখল করে নিয়েছে।

ডেইলি স্টার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ইকো রিসোর্টের সীমানার ভেতরে তিনটি কবর দেখতে পায়।

নরসিংদীর ওয়ান্ডার পার্ক ও ইকো রিসোর্ট। যেখানে লাকি এবং তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। ছবি: স্টার

১৩৩ দশমিক ৫ শতক জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্টটির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫৩ দশমিক ৯ লাখ টাকা।

আলতাফ হোসেন বলেন, এই এলাকায় প্রতি শতক জমির দাম প্রায় ৫ লাখ টাকা। এতে শুধু জমির দাম দাঁড়ায় অন্তত ৬ কোটি টাকা।

এছাড়াও, লাকি তার হলফনামায় ঢাকায় রাজউকের একটি ৫ কাঠা প্লটের উল্লেখ করেছেন। যার দাম দেখিয়েছেন মাত্র ১৪ লাখ টাকা। তবে অবস্থান ভেদে রাজউকের প্লটের প্রতি কাঠা জমির দাম অনেক বেশি।

এছাড়া তার ১৫৫ শতক কৃষিজমি থাকলেও হলফনামায় তার মূল্য উল্লেখ করা হয়নি।

২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সাদেক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর লাকি প্রথম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান হন।

গত ২৯ মে রায়পুরায় ভোট হওয়ার কথা থাকলেও নির্বাচনের আগে এক প্রার্থীর মৃত্যুর পর নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ স্থগিত করে।

হলফনামায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় লাকির ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের একটি ফ্ল্যাট দেখানো হয়েছে। যা প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক কম দেখানো হয়েছে।

প্রপার্টি ডেটাবেজ অনুযায়ী, ওই এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের দাম ১০ হাজার টাকার ওপরে, অর্থাৎ অর্থাৎ একটি ছোট এক হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের দামও এক কোটি টাকার বেশি হবে।

এছাড়া মিরপুরের শেলটেক বীথিকা নামে একটি কনডোমিনিয়ামে লাকি চারটি ফ্ল্যাটের মালিক, যার মোট মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত ফ্লোর প্ল্যানে দেখা যায়, ফ্ল্যাটগুলোর প্রতিটির আয়তন ১ হাজার ৫২৫ বর্গফুট এবং সম্পত্তির তালিকা অনুযায়ী প্রতি বর্গফুটের মূল্য ৬ হাজার ৮৫০ টাকা। অর্থাৎ চারটি ফ্ল্যাটের মোট মূল্য ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এই ধরনের কম টাকা দেখানোর আরেকটি উদাহরণ হলো তার আয়কর নথিতে আসবাবপত্রের মূল্য, মাত্র ৭৫ হাজার টাকা দেখানো।

ডেইলি স্টারকে লাকি বলেন, তিনি এবং তার পরিবার ঈর্ষার শিকার হয়েছেন।

তিনি বলেন, 'যে ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা খুবই মর্মাহত। আমরা নিরীহ মানুষ। কিছু সত্যের পাশাপাশি মিথ্যা দিয়ে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে। আমার স্বামী তার চাকরিতে ভালো কাজ করেছেন। যারা তার পেশাগত সাফল্যে ঈর্ষান্বিত তারা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনার ষড়যন্ত্র করেছে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।'

Comments