৭৪ বিক্ষুব্ধ নাগরিকের বিবৃতি

‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের’

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের পাকিজা এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ। ছবিটি গত ১৯ জুলাই তোলা। ছবি: আকলাকুর রহমান আকাশ/ স্টার

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ-সহিংসতায় যে বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তার দায় প্রধানত সরকারের বলে মন্তব্য করেছেন এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৭৪ জন নাগরিক।

আজ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা বলেছেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে থাকা  শিক্ষার্থীদের ওপর গত ১৬ জুলাই থেকে পুলিশসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী এবং সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রীর প্ররোচনায় তাদের আর্শীবাদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনের সহিংস কর্মীরা নজীরবিহীন দমন-পীড়নের তাণ্ডব চালিয়েছে। শুরু থেকেই সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনকে সরকারি দল যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করতে চেয়েছে, তেমনি বিরোধী পক্ষও  ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সংহতির নামে একে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে 'ছাত্র-জনতা হত্যা ও জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টের নাশকতার পেছনে যে কোন ধরনের অপরাজনীতির' নিন্দা জানান বিবৃতিদাতারা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'আমাদের আশঙ্কা সরকারি বাহিনী ও সরকারি দলের সংগঠনগুলোর আক্রমনে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক ব্যাপক, অনেক ভয়াবহ; যা ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমের উপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারণে আমরা জানতে পারছি না। এত অল্প সময়ে কোনো একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে এমন বিপুলসংখ্যক হতাহতের নজির গত একশ বছরের ইতিহাসে (মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বাদে) আমাদের দেশে তো বটেই, এই উপমহাদেশেও মিলবে না।'

এ পর্যায়ে 'এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের'—এমন মন্তব্য করে সেখানে বলা হয়, 'সাংবিধানিক শপথ এবং আইন উপেক্ষা করে একাধিক মন্ত্রী যেভাবে চরম দায়িত্বহীন ভাষায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর তাদের সমর্থক ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানালেন, তাতে সারা দেশ ও বিদেশে বাংলাদেশের জনগণ এবং দেশের শুভকাঙ্ক্ষীরা স্তম্ভিত, গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হয়েছেন।

'আমরা গভীর মর্মবেদনার সাথে এও লক্ষ্য করেছি যে, দেশের বেসামরিক নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দমনের জন্য জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত সাঁজোয়া যান রাস্তায় নামানো হয়েছিল, সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়োজিত করা হয়েছিল, কারফিউ জারি করে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং হেলিকপ্টার থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও অভিযোগমতে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজীরবিহীন।'

এই আন্দোলন চলাকালে নাশকতামূলক তৎপরতার কারণে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। বলা হয়, 'নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এইসব নাশকতার জন্য যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তির দাবি আমরা জানাচ্ছি। তবে এই অজুহাতে ভিন্নমতের কাউকে দমন-পীড়ন বা সাধারণ মানুষকে হয়রানি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য না।'

এছাড়া 'ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও গুলিবর্ষণের ঘটনার কোনো তদন্ত না করে কেবল নাশকতার মামলা দায়েরের মাধ্যমে হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করা ও কয়েক হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তারের' ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয় বিবৃতিতে। বলা হয়, 'শিক্ষার্থী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও কর্মীদের কয়েকজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হাসপাতাল থেকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে; যা অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও নিপীড়নমূলক।'

এতে আরও বলা হয়, 'গণমাধ্যম থেকে এও জানা গেছে যে এলাকা ভাগ করে পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য বাহিনী "ব্লক রেইড" ও নির্বিচার গ্রেপ্তার করে জনমনে, পরিবারসমূহে এবং তরুণ সমাজের মনে সীমাহীন ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করেছে। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার বদলে আরও জটিল ও অশান্ত করে তোলার ইন্ধন যোগাবে বলে আমাদের আশঙ্কা।'

এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ও সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ এবং শিক্ষামুখী রাখতে বেশ কিছু দাবিও জানানো হয় বিবৃতিতে। পাশাপাশি দেশবাসীকেও কঠিন আত্মপ্রত্যয়ে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়।

দাবিগুলো হলো—

*জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্দোলনে পুলিশ, র‌্যাব, অন্যান্য বাহিনী কিংবা সরকারের মদদপুষ্ট বেসরকারি অস্ত্রধারীদের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থী, শান্তিপ্রিয় নাগরিক, কিশোর-কিশোরী এমনকি শিশু নিহত, নির্যাতিত ও আহত হওয়ার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত হতে হবে।

*নিহতদের প্রতি জাতির সহানুভূতি, শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় শোক পালনের ঘোষণা দিতে হবে। নিহত-আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত সংখ্যা, নাম-পরিচয় সরকারকে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে।

*দায় মেনে নিয়ে সরকারকে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসার দায়িত্ব নিতে হবে। যারা চোখ-হাত-পা হারিয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে।

*গণরুম ও টর্চার সেলকেন্দ্রিক নির্যাতনের অবসান ঘটানোর সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বিচার গ্রেফতার, আটক ও আটক রেখে বিবৃতি আদায়, দমন-পীড়ন, শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের স্বজনদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুলিশ ও র‌্যাবের লাগামহীন হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

*স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কারফিউ তুলে নিতে হবে। দেশের ছাত্র-জনতাকে দমন-পীড়ন কিংবা ভয়-ভীতি প্রদর্শনের জন্য যে সকল সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাস্তায় নামানো হয়েছে, তা অবিলম্বে স্ব স্ব জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে ইন্টারনেটের ওপর সকল সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটাতে হবে এবং ভিন্নমতের মানুষকে হয়রানি ও তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।

বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষরকারীরা হলেন, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, হামিদা হোসেন ও খুশী কবির, আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক, মানবাধিকার কর্মী রাশেদা কে. চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ হোসেন জিল্লুর রহমান, আনু মুহাম্মদ ও দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মানবাধিকারকর্মী ও গবেষক মেঘনা গুহঠাকুরতা, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, মানবাধিকারকর্মী ইফতেখারুজ্জামান,  অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নারী অধিকারকর্মী শিরিন হক, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মানবাধিকার ও ভূমি অধিকারকর্মী শামসুল হুদা, গবেষক ও পর্যবেক্ষক বদিউল আলম মজুমদার, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অধ্যাপক পারভীন হাসান, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন,  অধ্যাপক মো. তানজিমউদ্দিন খান, অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, অধ্যাপক মুশতাক এইচ খান, অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, অধ্যাপক বীনা ডি কস্তা, অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক নোভা আহমেদ, অধ্যাপক নাভীদা খান, শিক্ষাবিদ স্বপন আদনান ও দীনা সিদ্দিকী, পোস্টডক্টরাল গবেষক নাসরিন খন্দকার, সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ফারহা তানজিন তিতিল, মাইদুল ইসলাম ও রিজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী ও তবারক হোসেন, মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার শুভ্র চক্রবর্তী, আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, সাইদুর রহমান, প্রিয়া হাসান চৌধুরী ও শারমিন খান, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা নাসের বখতিয়ার, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাঈদা গুলরুখ ও সালিম সামাদ, মানবাধিকারকর্মী শারমিন মুরশিদ, ফস্টিনা পেরেইরা, রুশাদ ফরিদী, রেজাউল করিম লেলিন, নুর খান, রেজাউল করিম চৌধুরী, সাদাফ নুর ও তাসনিম সিরাজ মাহাবুব, আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী শহিদুল আলম, লেখক-গবেষক রেহনুমা আহমেদ ও আলতাফ পারভেজ, কবি-লেখক আহমেদ স্বপন মাহমুদ, মানবাধিকারকর্মী জাকির হোসেন, মাহিন সুলতানা ও রোজিনা বেগম, গবেষক বারিশ হাসান চৌধুরী ও রেজওয়ান ইসলাম, মানবাধিকার কর্মী জাহানারা খাতুন, ফজিলা বানু লিলি, আরিফা হাফিজ, ইশরাত জাহান প্রাচী ও দীপায়ন খীসা, আদিবাসী অধিকারকর্মী হানা শামস আহমেদ, নারী অধিকারকর্মী মুক্তশ্রী চাকমা, এবং সাংস্কৃতিক কর্মী অরূপ রাহী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Threat of fresh Rohingya influx looms as clashes erupt in Myanmar

Gunfire and explosions were heard late Friday night from villages across the border in Myanmar opposite Whykong union in Teknaf upazila of Cox’s Bazar. Residents, gripped by panic, reported that this was the most intense gunfire they had heard in months.

4h ago