‘হাসিনার পতন হইছে’ শুনে শেষবার হেসেছিলেন স্বজন

মো. আবুল হাসান স্বজন। ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাত ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যায় ছিলেন আবুল হাসান স্বজন। জ্ঞান ফেরার পর বড় ভাই অনিকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে কি না। উত্তর শুনে হেসেছিলেন স্বজন। সেটাই ছিল তার শেষ হাসি।

গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় গুলিবিদ্ধ হন স্বজন। সেসময় চাষাঢ়ায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলছিল। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ওইদিন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে গুলি করেছিলেন বলেও জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কুশিয়ারা গ্রামের জাকির হোসেন ও আফিয়া বেগম দম্পতির ছোট ছেলে আবুল হাসান স্বজন। ২০২২ সালে বন্দরের হাজী আব্দুল মালেক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে শিক্ষাজীবন আর এগোয়নি।

পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতিতে একটি কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি শুরু করেন স্বজন। ছয় মাস আগে বড় ভাইয়ের চাকরি চলে যাওয়ায় পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পরে ২০ বছর বয়সী এই তরুণের কাঁধে।

গত জুনে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শুরু হওয়া আন্দোলন জুলাইয়ের শেষ দিকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ৫ আগস্ট 'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন স্বজনের বড় ভাই মো. অনিক। কারফিউর থাকার কারণে অফিস করতে হচ্ছিল না। তাই ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় যাওয়ার কথা জানায় স্বজনও। প্রথমে অনিক তাকে সঙ্গে নিতে না চাইলে পরে রাজি হন।

'আমরা ১১ জন ঘাট পার হয়ে শহরে আসি। চাষাঢ়া চত্বরে তখন আরও কয়েকশ মানুষ। হঠাৎ একটি মিছিল আসলে হট্টগোল লেগে যায়। তখন স্বজন আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরমধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আমি শহীদ মিনারে গিয়ে বসি। এমন সময় একজন এসে জানায়, আমার ভাই গুলি খাইছে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হইছে', বলছিলেন অনিক।

নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে অনিক দেখেন, তার ভাই স্বজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ভোরে মারা যান স্বজন।

হাসপাতাল থেকে ইস্যু করা মৃত্যুসনদে স্বজনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'গান শট' উল্লেখ রয়েছে।

অনিক বলেন, 'প্রথমে স্বজনের শরীরে গুলি খুঁজে পাচ্ছিলেন না ডাক্তার। স্ট্রেচার তখনও রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। ডাক্তার চার ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করার কথা বললেও হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের সংগ্রহে রক্ত ছিল না। আমাদের কান্না দেখে উপস্থিত কয়েকজন রক্ত দিতে রাজি হন। এরপর দ্রুত এক ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। সাত ঘণ্টা পর অপারেশন সফল হয়েছে বলে জানান ডাক্তার।'

পরদিন ভোররাত ৩টার দিকে আইসিইউর শয্যায় স্বজনের সঙ্গে কথা হয় অনিকের। তখন স্বজন জানতে চেয়েছিলেন, 'শেখ হাসিনার কি পতন হইছে?'।

অনিক বলেন, 'এটা শুনে আমি রেগে যাই, ওকে বকাঝকা করি। আমি তখনও জানি না দেশের কী অবস্থা। আইসিইউ থেকে বের হয়ে বন্ধুর কাছে জানতে পারি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। আধঘণ্টা পরে স্বজনের সঙ্গে আবার যখন দেখা করি তখন বিষয়টা জানাই। খবরটা শুনে ভাই আমার মুচকি হেসেছিল। ওইটাই ছিল আমার ভাইয়ের শেষ হাসি। কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার জানান, ভাই আমার আর নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago