মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের খরচ বাড়ছে যেসব কারণে

একনেক সংশোধনের পর প্রকল্পের মোট খরচ এখন দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। এটি প্রাথমিক খরচ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে ছয় হাজার ৬০৪ কোটি টাকা বেশি।
মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর। স্টার ফাইল ফটো

অনুমোদনের চার বছর পর কক্সবাজারের মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের খরচ বেড়ে গেলেও এর বাস্তবায়নের সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যদিও প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি এখনো শূন্য, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে—মূল পাঁচ কারণ প্রকল্পটির ৩৭ শতাংশ খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।

গত সোমবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় জমা দেওয়া সরকারি নথিতে বলা হয়েছে—প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে আছে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়া, ভূমি অধিগ্রহণে অতিরিক্ত খরচ ও নকশায় পরিবর্তন।

একনেক সংশোধনের পর প্রকল্পের মোট খরচ এখন দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। এটি প্রাথমিক খরচ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা থেকে ছয় হাজার ৬০৪ কোটি টাকা বেশি।

'মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন' নামে প্রকল্পটি ২০২০ সালের মার্চে নেওয়া হয়। ২০২৬ সালের মধ্যে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। এখন তা পিছিয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরে করা হয়েছে।

গত মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মূল নির্মাণ কাজ শুরু না হওয়ায় প্রকৃত অগ্রগতি এখনো শূন্য।

দেশের পণ্য খালাসের সক্ষমতা বাড়ানো, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানো ও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের চাহিদা মেটাতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।

মাতারবাড়ীতে বিগত সরকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের সূত্র ধরে গভীর সমুদ্রবন্দরের ধারণা আসে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জ্বালানি আমদানির জন্য প্রশস্ত চ্যানেল ও বন্দরের প্রয়োজন।

প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাওয়ার পেছনে যে পাঁচ কারণ দেখানো হয়েছে এর মধ্যে ডলারের দাম ওঠানামাকে মূল হিসেবে দেখিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

২০২০ সালে প্রকল্পটি নেওয়ার সময় ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা। এখন তা ১১৯ টাকা।

এ ছাড়াও, শুল্ক ও ভ্যাটসহ রাজস্ব পরিশোধে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণের খরচ বেড়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

তৃতীয়ত, বিস্তারিত নকশায় পরিবর্তনের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত ৬৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। একে আনুষ্ঠানিকভাবে 'কাজের পরিধি পরিবর্তন' হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

প্রকল্প নথি অনুসারে, বন্দরের সড়ক ও মহাসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১৬ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার। প্রাথমিক পরিকল্পনায় তা ছিল ২৭ দশমিক ৫১ কিলোমিটার। সংশোধিত পরিকল্পনায় সেতুর দৈর্ঘ্য আগের সাত কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ১০ কিলোমিটার করা হয়েছে।

এই সব মিলিয়ে 'কাজের পরিধি পরিবর্তনের' জন্য খরচ বেড়েছে।

চতুর্থত, কয়েক বছর ধরে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ কাজের রেট শিডিউলে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

প্রকল্প কর্তৃপক্ষের ধারণা, তিন বছর সময় বাড়ানোর কারণে পরামর্শক খরচ আরও বাড়বে।

'একটি পয়সাও অযথা খরচ হবে না'

একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, 'মূল প্রকল্প গভীর সমুদ্রবন্দর হলেও অ্যাপ্রোচ সড়ক ও সেতু নির্মাণে অনেক টাকা খরচ হবে।'

সড়ক ও সেতুর খরচ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, প্রকল্পে কোনো 'অপ্রয়োজনীয়' বা 'অতিরিক্ত' টাকা খরচ হবে না।

উপদেষ্টা বলেন, 'একনেকের অনুমোদনই চূড়ান্ত নয়। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো নিয়মিতভাবে প্রকল্পের উন্নয়ন মূল্যায়ন করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যাতে অনিয়ম না ঘটে সেজন্য উন্নয়ন সহযোগীরা সহযোগিতা করবে। পরবর্তী সরকার কী করবে তা বলতে পারব না। এ বিষয়ে আমরা কিছু বিধিমালা করতে চাই।'

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যমান প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করতে সরকারের সম্মতি নিতে হবে। বিশেষ করে, বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা পাওয়া গেছে।'

সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, 'দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর খুবই দরকার। ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের অতিরিক্ত চাপ সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা চট্টগ্রাম ও পায়রাসহ অন্যান্য বন্দরের নেই।'

দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর না থাকায় সিঙ্গাপুর বা কলম্বো বন্দরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করায় পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। 'এটি সময়সাপেক্ষও,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'চীন বা ভারত এই প্রকল্পে কাজ করবে কিনা তা নিয়ে অনেক আলোচনা ছিল। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আসলে কিছুই হচ্ছে না।'

অবশেষে সরকার জাপানকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নিয়েছে। জাপান কম সুদে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়।

এ ছাড়া, জাপান সাধারণত সময়মতো প্রকল্প শেষ করে। মেট্রোরেল ও ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এর প্রমাণ।

তিনি বলেন, 'কোনো জাপানি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি করেছে এমনটি শুনিনি। এ কারণে জাপানকে এই প্রকল্পের জন্য বাছাই করা হয়েছে।'

Comments