সেই রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যা ঘটেছিল
৩ নভেম্বর ১৯৭৫। রাতের আঁধারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হলো মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে।
এই নির্মম ঘটনার ঠিক আগে একই বছরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
কারাগারের ভেতর এই জাতীয় চার নেতাকে হত্যার অনুপুঙ্খ বিবরণ উঠে এসেছে বর্বরোচিত এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং কারাগারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য, এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও বিভিন্ন লেখায়।
এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের দুইদিন পর স্বরাষ্ট্রসচিবকে দেওয়া তৎকালীন আইজি প্রিজনস এন নুরুজ্জামান এবং ডিআইজি প্রিজনস কাজী আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান, সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ মৃধাসহ অনেকের বক্তব্য থেকেও সে রাতের বিবরণ পাওয়া যায়।
জেলহত্যা নিয়ে তৎকালীন আইজি প্রিজনস ও ডিআইজি প্রিজনসের প্রতিবেদনটি দীর্ঘ ২১ বছর ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে তা ১৯৯৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর এন নুরুজ্জামানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২ নভেম্বর রাত ৩টার দিকে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদ নুরুজ্জামানকে ফোন করেন। তিনি জানতে চান—কেন্দ্রীয় কারাগারে কোনো সমস্যা আছে কি না।
নুরুজ্জামান বলেন, এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় কারাগারে কোনো সমস্যা নেই। এরপর রশিদ তাকে বললেন, কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনা জেল গেটে যেতে পারে। নুরুজ্জামান যেন গার্ডদের সতর্ক করে দেন।
একটু পরেই কারাফটকে দায়িত্বরত ওয়ার্ডারকে ফোন করে নুরুজ্জামান নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ দেন। কয়েকমিনিটের মধ্যে আবার বঙ্গভবন থেকে নুরুজ্জামানকে ফোনে জিজ্ঞেস করা হয় গার্ডদের সতর্ক করার ব্যাপারে। পাশাপাশি তিনি যেন দ্রুত জেলগেটে গিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখা আসেন, সে নির্দেশনাও দেওয়া হয় তাকে।
এরপরই ডিআইজি প্রিজনস আবদুল আউয়ালকে ফোন করেন আইজি প্রিজনস নুরুজামান। তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ জেলগেটে যেতে বলে নিজেও কারাগারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
জেলগেটে পৌঁছানোর পর বঙ্গভবন থেকে আবার মেজর রশিদের ফোন আসে। মেজর রশিদ ওপ্রান্ত থেকে জানান, মোসলেম নামের জনৈক ক্যাপ্টেন জেলগেটে যাবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কারাগারে বন্দী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে দেখিয়ে দেওয়া হয়।
একথা শুনেই নুরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে কথা বলতে চান। মেজর রশিদ খন্দকার মোশতাককে টেলিফোন ধরিয়ে দেন। খন্দকার মোশতাক অপরপ্রান্ত থেকে পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছেন কি না—তা নুরুজ্জামানের কাছে জানতে চান এবং পরিপূর্ণভাবে তাদের নির্দেশ পালনের আদেশ দেন।
এর কয়েকমিনিট পর ক্যাপ্টেন মোসলেম চারজন সেনাসহ জেলগেটে এসে তাদের বন্দীদের কাছে নিয়ে যেতে বলেন। নুরুজ্জামান বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তাকে কিছু বলার জন্য বললে ক্যাপ্টেন মোসলেম বললেন, 'আমরা তাদের গুলি করবো'।
এ কথায় স্তম্ভিত হয়ে যান নুরুজ্জামান। এরপর তিনি ও ডিআইজি প্রিজনস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাননি। তখন জেলার আমিনুর রহমানের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদ কল করেন। কল ধরলে মেজর রশিদ প্রেসিডেন্ট মোশতাককে ধরিয়ে দেন। নুরুজ্জামান ক্যাপ্টেন মোসলেমের ইচ্ছার কথা জানালে প্রেসিডেন্ট মোশতাক বলেন, 'সে যা বলছে তাই হবে।'
তখন আইজি প্রিজনস, ডিআইজি প্রিজনস ও জেলার উত্তেজিত হয়ে পড়লে তাদের বন্দুকের নলের মুখে জাতীয় চার নেতার সেলের কাছে নেওয়া হয়। এ সময়ের ভেতর চার নেতার সবাইকে একটি কক্ষে আনা হয়েছিল। জেলার তাদের শনাক্ত করেন। পরে ক্যাপ্টেন মোসলেম ও আগত সেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে নায়েক এ. আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল বেয়নেট চার্জ করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
পঁচাত্তরের ৫ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবর দেওয়া ডিআইজি প্রিজনস আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদনে নুরুজ্জামানের বক্তব্যের প্রথমাংশের হুবহু বর্ণনা পাওয়া যায়। বাকি অংশে আবদুল আউয়াল উল্লেখ করেন, আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামানের নির্দেশে তিনি রাত ৩টা ২০ মিনিটে জেলগেটে পৌঁছান। ততক্ষণে জেলার ও আইজিও সেখানে উপস্থিত হন। বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুসারে তাকেই বন্দী জাতীয় চার নেতাকে চিনিয়ে দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন মোসলেম চারজন সেনাসহ স্টেনগান ও এসএলআর নিয়ে কারাগারে ঢোকেন। একপর্যায়ে ক্যাপ্টেন মোসলেম গুলি করবেন বলে জানান।
এসময় আবদুল আউয়াল প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে পোষণ করলেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম তখন হুমকির সুরে বললেন, 'আপনি ভয় পাচ্ছেন?' আবদুল আউয়াল জবাবে বললেন, 'আমার ৩২ বছরের চাকরি জীবনে আমি এ জাতীয় ঘটনার কথা শুনিনি।' ইতোমধ্যে ক্যাপ্টেন মোসলেমের নির্দেশে তারা জাতীয় চার নেতাকে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা করলেন এবং তাদের একটি ওয়ার্ডে জড়ো করা হয়। সেই ওয়ার্ডে যারা ছিল, তাদের সবাইকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু কালক্ষেপণের জন্য ক্যাপ্টেন মোসলেম বললেন, 'শেখ মুজিবকে খতম করতে আমাদের মাত্র ৩ মিনিট সময় লেগেছিল।' তখন ক্যাপ্টেন মোসলেমকে জানানো হলো বন্দীদের ওয়ার্ডে আনা হয়েছে।'
এরপরই তখনই ক্যাপ্টেন মোসলেম ও সেনারা ওয়ার্ডে চলে গেলেন। ওয়ার্ডের একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন নুরুজ্জামান এবং আবদুল আউয়াল। কিছুক্ষণ পরেই ভেসে এলো গুলির শব্দ। খুনিরা ফিরে এসে জেলগেটের দিকে এগিয়ে যায়। রেকর্ড অনুসারে ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে ঢোকেন ভোর ৪টায় এবং জেলগেট থেকে বেরিয়ে যানা ৪টা ৩৫ মিনিটে।
এরপর ভোর ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে একটি দল গুলি করার জায়গাটি পরিদর্শন করে জাতীয় চার নেতার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। তারা ওয়ার্ডে ঢুকে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের শরীরে বেয়নেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। ভোর ৫টা ৩৫ মিনিটে জেল থেকে চলে যায় দলটি।
আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান জেল ত্যাগ করেন ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে। ডিআইজি প্রিজনস আবদুল আউয়াল কারাগার ছেড়ে বেরিয়ে যান সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটে। পরে আবার সকাল ৮ টা ৩৫ মিনিটে তিনি কারাগারে আসেন।
জেল হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান ও সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ মৃধার বক্তব্যেও পাওয়া যায় সেই ভয়াল ঘটনার বিবরণ।
সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ মৃধা
২ নভেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে হঠাৎ পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনে সুবেদার আবদুল ওয়াহেদ মৃধা দৌড়ে জেলগেটে আসেন। এসময় তার পরনে ইউনিফর্ম ছিল না। জেলগেটে এসে তিনি দেখেন সব অফিসার উপস্থিত। সবাই যেন কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।
জেলার আমিনুর রহমান তখন ওয়াহেদ মৃধাকে ইউনিফর্ম পরে আসার আদেশ দিলেন। ইউনিফর্ম পরে তিনি যখন এলেন তখন রাত তিনটা বেজে গেছে। জেলার আমিনুর রহমান পাগলা ঘণ্টার কারণ জানতে ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
এরপর ভেতরে গিয়েও কারণ বুঝতে পারলেন না সুবেদার মৃধা। একটু পর জেলার তাকে জাতীয় চার নেতাকে একসঙ্গে করার আদেশ দিলেন। সুবেদার মৃধা এরিয়া জমাদারকে ডেকে গেট খুললেন। ১ নম্বর রুমে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি সুবেদার মৃধাকে বললেন, 'কি বিষয় পাগলা ঘণ্টা বাজছে কেন?' জবাবে সুবেদার মৃধা বললেন, 'আর্মি এসেছে।'
১ নম্বর সেলে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম । দ্বিতীয় ও তৃতীয় সেলে ছিলেন কামারুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। বাকি দুই রুম খোলার সময় মৃধাকে সবাই জিজ্ঞেস করলেন, 'কী ব্যাপার?' জবাবে সুবেদার মৃধা বললেন, 'বোধহয় নতুন মন্ত্রীসভা গঠন হবে তাই আপনাদের নিয়ে যাবে।'
চারজনকে ১ নম্বর সেলে আনার পর তাজউদ্দীন আহমদ বাকি তিনজন নেতার উদ্দেশ্যে বললেন, 'সময় নেই। অজু করে আসেন। চারজনই বাথরুম থেকে ওজু করে নিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের চৌকিতে চারজন বসলেন। এসময় ঘাতক চারজন ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ার। খুব নিকট থেকে প্রায় ৬০ রাউন্ড গুলি করা হলো তাদের উপর। গুলি শেষ করেই ঘাতকেরা দৌড়ে জেলগেটের দিকে চলে গেল। গুলিতে ১ নম্বর সেলের টেবিলে রাখা কোরআন শরীফ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল পুরো সেল।
জেলার আমিনুর রহমান
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আমিনুর রহমান বলেন, ২ নভেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে আইজি প্রিজনস তাকে টেলিফোন করে নিচে যাওয়ার আদেশ দেন। এরপর তিনি নিচে গিয়ে নানা কার্যসম্পাদন করেন। তার নির্দেশেই সুবেদার মৃধা সেল খুললেন।
সেলের চাবি খোলার সময় তাজউদ্দীন আহমদ জেলারকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি আর্মি এসেছে বলে জানান। এরপর তিনি অন্য দুটি সেল খুলে দেন। সেই দুটি সেল থেকে বেরিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামান।
তিনি ধারণা করেছিলেন, সেনা সদস্যরা যখন এসেছে ওরা হয়তো কিছুক্ষণ বসবে। কথা বলবে। তাই তিনি বসার জন্য দুইপাশে চৌকি ঠিক করে দিয়ে বসার জন্য কয়েকটি টুল দিলেন।
এরপর তাজউদ্দীন আহমদ বাথরুমে গেলেন। জাতীয় চার নেতা এরপর কাপড় বদলিয়ে অজু করলেন, নামাজ পড়লেন, পানি খেলেন। এসব করতে করতে কিছুক্ষণ সময় গেল।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সুটকেস খুলে একটি ধোয়া পাঞ্জাবি পরে মুখে পাউডার মেখে বের হন। তখন আইজি প্রিজনসকে জেলার বললেন, 'স্যার তাদেরকে এক রুমে আনা হয়েছে।' তিনি এই কথা বলামাত্রই দুজন সেনা ঐ সেলের দিকে হাঁটা শুরু করলো।
জেলার আমিনুর রহমান জাতীয় চার নেতাকে সেনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে প্রথমে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর দিকে তাকিয়ে 'He is Mr. Mon…" বলতেই দুজন ব্রাশফায়ার করতে শুরু করল। তৎক্ষণাৎ বাইরে থাকা বাকি দুজনও গুলি করতে করতে সেলের ভিতরে ঢুকল। তাদের গুলি গিয়ে লাগলো জানালার লোহার শিকে। হত্যাকারীদের হাতে ছিল চাইনিজ রাইফেল ও স্টেনগান। তবে গুলি করেছে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে। জেলার আমিনুল ইসলাম বলেন, 'ওরা যখন গুলি করছিল তখন ফজরের আজান হচ্ছিল চকবাজার বড় মসজিদে।'
সূত্র: আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ/সিমিন হোসেন রিমি
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬
Comments