বাঁধের কারণে মৃত্যুর মুখে আরও একটি নদী

নীলফামারীর ডিমলায় কুমলাই নদ এখন মৃত্যুর মুখে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/স্টার

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তার শাখা নদী কুমলাই এখন মৃত্যুর মুখে।

এই নদীর উভয় প্রান্তই তিস্তার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু তিস্তায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্মিত একটি বাঁধ এই নদীর উৎস ও পতিতস্থল উভয়ই বন্ধ করে দেয়। এখন বর্ষায় নদীর পানি কূল ছাপিয়ে আশেপাশের গ্রামগুলোকে প্লাবিত করে দেয়। আর বছরের বাকি সময় পানিবিহীন থাকে কুমলাই।  

অভিযোগ আছে, ভূমিদস্যুদের সহায়তায় এই বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এরপর শৈল্ল্যার বাঁশতলা ও মতির বাজারে দুই জায়গায় দুটি খাল কেটে কুমলাইয়ের পানি ধূম ও নাউতারা নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। 

কুমলাই সংলগ্ন গয়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা সাইফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, এই খালগুলো দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়ায় প্রায় সম্পূর্ণ নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ে। শুকনো নদীবক্ষে তখন দখলের বেপরোয়া উৎসব শুরু হয়।

স্থানীয় সমাজকর্মী আলমগীর কবির বলেন, 'এলাকার মানুষ পাউবোর কাছে দাবী জানিয়েছিল, খাল কেটে সরাসরি সব পানি বের না করে সেখানে রেগুলেটর বা স্লুইসগেট নির্মাণ করা হোক। সেটা করলে বর্ষায় গেট খুলে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া যেত। বাকি সময় গেট বন্ধ করে পানি সংরক্ষণ করা যেত। এভাবে নদীটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতো।'

এ বিষয়ে পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী আকাশ দত্তের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, 'বন্যা কিংবা নদী ভাঙ্গন থেকে মানুষ, পশুপাখি, ফসল রক্ষায় খাল কেটে কোনো নদীর পানি অন্য নদীতে স্থানান্তর করা আমাদের দপ্তরের একটি অনুমোদিত পদ্ধতি যা আমরা বিভিন্ন স্থানে করেছি।' কিন্তু এলাকাবাসীর দাবী স্বত্বেও বাঁধ ও উন্মুক্ত খালের বদলে রেগুলেটর বা স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়নি কেন, এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি তিনি।

কুমলাই জাতীয় নদী রক্ষা কমিটি ও পাউবোর তালিকাভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। ১৮৮৮ সালে পরিচালিত ক্যাডেস্টাল সার্ভে (সিএস) ও ১৯৫৬ সালে পরিচালিত সেটেলমেন্ট এ্যাসেসমেন্টে (এসএ) এই নদীর সীমানার সুস্পষ্ট রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ সার্ভেতে (বিএস) নদীবক্ষের বহু জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন দেখানো হয়েছে। 

মতির বাজার এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বাসিন্দা মোকছেদ আলি বলেন, 'ছোটবেলায় কুমলাইকে অনেক গভীর ও প্রশস্ত রূপে দেখেছি। (এই নদী) বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা দেখা যেত। পানিতে শুশুক ও বাঘাইর মাছ পাওয়া যেত অহরহ। কিন্তু এখন এসব কেবল স্মৃতি।'

সম্প্রতি নদীটি সরেজমিনে দেখতে সুটিবাড়ী, খালিশা চাপানী, ছোটখাতাসহ বিভিন্ন গ্রামে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, নদীর সীমানার ভেতরেই অনেক বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মহিলা মার্কেটের দেখা মেলে। 

জেলার অন্যতম বৃহৎ বাজার সুটিবাড়ী হাটের পাশে নদী দখলের হার প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্থানীয় সরকারের প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেখানে দুটি পাকা রাস্তাও বানানো হয়েছে। 

খালিশা চাপানী এলাকায় দেখা যায়, হাজী আব্দুস সবুর নামে এক ব্যক্তি নদীর জায়গা দখল করে একটি বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, তার কাছে জায়গার মালিকানার দলিল রয়েছে। 

এলাকার একাধিক দখলদার দাবি করেন, তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জমির নিবন্ধিত দলিল পেয়েছেন এবং নিয়মিত ইউনিয়ন ভূমি অফিসে রাজস্ব পরিশোধ করছেন। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. নায়রুজ্জামান বলেন, 'জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তিকে নদীর জমির কবুলিয়াত দেওয়া হয়নি। আমরা ২৭৩ জন দখলদারের তালিকা করেছি এবং কুমলাই উদ্ধারের অংশ হিসেবে শীঘ্রই তাদের উচ্ছেদে অভিযান শুরু করব।'

নদী রক্ষায় কাজ করা সংগঠন 'রিভারাইন পিপল' স্থানীয়দের নিয়ে কুমলাই পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তুহীন ওয়াদুদ বলেন, 'পাউবো তিস্তায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে কুমলাই নদীর উৎস ও পতিতমুখ বন্ধ করে এটিকে হত্যা করেছে। কুমলাইসহ অন্যান্য নদী রক্ষায় আমরা সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি পেশ করেছি। আমরা কুমলাই রক্ষায় স্থানীয়দের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাই।' 

পাউবোর উত্তরাঞ্চলীয় দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান বলেন, 'নদীটি উদ্ধারের ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। এটি খননের জন্য আমাদের একটা উন্নয়ন প্রস্তাবনা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়েছে।' 

Comments

The Daily Star  | English

Palli Bidyut Protest: Staff shortage sparks concerns over Eid power supply

Demonstrators' demands include removal of REB chairman, unified service rule

3h ago