ইউএসএআইডির তহবিল বন্ধ: চাকরি হারিয়ে দুশ্চিন্তায় বাংলাদেশের উন্নয়নকর্মীরা

গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে উন্নয়ন খাতে নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন সাইফুল আলম। ঢাকায় বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থবিভাগে কাজ করেছেন তিনি।

কিন্তু হঠাৎই তার জীবনে নেমে এসেছে দুঃসময়। ৪৭ বছর বয়সে অপ্রত্যাশিতভাবে বেকার হয়ে পড়েছেন তিনি। দুই সন্তান শহরের নামী স্কুলে পড়াশোনা করছে। কিন্তু এখন অন্য কোনো আয় না থাকায় শিগগিরই হয়তো তাকে পরিবার নিয়ে এই শহর ছাড়তে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) প্রকল্প বাতিলের নোটিশ দেওয়ায় অন্য অনেকের মতো তিনিও কাজ হারিয়েছেন। গত তিন বছর ধরে তিনি এই প্রকল্পে কাজ করছিলেন।

'আমি এখন প্রকল্পের হিসাবপত্র চূড়ান্ত করছি এবং ইউএসএআইডির ওয়াশিংটন কার্যালয়ে জমা দেওয়ার জন্য শেষ মুহূর্তের কাগজপত্র তৈরি করছি,' গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন সাইফুল।

'এরপর নিজেকে এক মাস সময় দেব নতুন চাকরি খোঁজার জন্য। যদি কিছু না পাই, তাহলে গ্রামে ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।'

উন্নয়ন অর্থায়নে এক দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থাকার পরও সাইফুলের আশঙ্কা, সংকুচিত হতে থাকা এই খাতে নতুন সুযোগ নেই বললেই চলে।

'আমার পুরো ক্যারিয়ারই উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু এই খাত এখন ধসে পড়ছে।'

'আমার মনে হয় না যে উন্নয়ন খাতে আর কোনো চাকরি পাব। আর কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই বা আমাকে সিনিয়র পদে কেন নিয়োগ দেবে?' হতাশা নিয়ে বলেন সাইফুল।

তাকে হয়তো এই শহর ছাড়তেই হবে।

'গ্রামে ফিরে যাওয়া আমার, আমার পরিবারের জন্য বিশেষ করে আমাদের বাচ্চাদের জন্য খুবই কঠিন হবে। সেখানে মানিয়ে নেওয়ার বিষয় আছে। আমি জানি না গ্রামে আমি কীভাবে আয়-উপার্জন করে বেঁচে থাকব। আমার বাচ্চারা কোথায় পড়বে? আমি সবকিছু মিলিয়ে খুবই হতাশার মধ্যে আছি,' বলেন তিনি।

সাইফুলের অবস্থা বৃহত্তর এই খাতের পুরো সংকটকেই যেন প্রতিফলিত করে। তহবিল ছাঁটাই এবং জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ায় এই খাতে কাজ করা অনেকের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশে ইউএসএআইডির প্রায় ১০০টি প্রকল্পের বেশিরভাগই বাতিলের সিদ্ধান্তের পর বেকারত্বের মুখোমুখি হওয়া হাজার হাজার উন্নয়ন পেশাজীবীদের মধ্যে সাইফুল একজন। প্রায় ৪০০টি এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত এসব প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এবং সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন কার্যক্রমকে সহায়তা দিয়েছে।

যদিও ইউএসএআইডির তহবিল কাটছাঁটের কারণে কত মানুষ চাকরি হারিয়েছে বা হারাতে পারে তার কোনো সরকারি তথ্য নেই, তবে এই খাত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এই সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে হতে পারে।

কূটনৈতিক সূত্র অনুসারে, ইউএসএআইডি প্রতি বছর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কৃষি, জীবিকা, শ্রম অধিকার, মানবপাচার রোধ এবং গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকে।

গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ইউএসএআইডির তহবিল এবং সংস্থাটির তহবিলভুক্ত কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেন।

বাংলাদেশে ইউএসএআইডি অফিসের সমস্ত মার্কিন কর্মকর্তাদেরও প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কর্মীদের একটি অংশ ওয়াশিংটন ডিসির ইউএসএআইডি অফিসে নথিপত্র পাঠানোর কাজ করছেন।

ট্রাম্প প্রশাসন ৯০ শতাংশেরও বেশি বৈদেশিক সহায়তা চুক্তি বাতিল এবং প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলার তহবিল কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ইউএসএআইডি এবং এনজিওগুলোর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার চুক্তি বাতিল করা হয়।

শিক্ষা প্রকল্পে কাজ করা সাইফুল বলেন, তারা ধারণা করেছিলেন যে ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গ সমতা এবং টিকাদান সম্পর্কিত প্রকল্পগুলো বাতিল করবেন কারণ তার নীতি এসব বিষয়কে সমর্থন করে না।

'আমাদের প্রকল্প বর্তমান মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং প্রকল্পের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করার বিষয়ে ইউএসএআইডির জবাব আমরা তৈরি করছিলাম, কিন্তু তার আগেই আমরা প্রকল্প বাতিলের চিঠি পাই,' বলেন সাইফুল।

আরেকজন উন্নয়নকর্মী অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়ন সম্পর্কিত একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এনজিও কর্মীদের মধ্যে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।

এটি তাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং সময়, কারণ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের আগ্রহ কম থাকায় ইউএসএআইডি প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে এবং ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সুরক্ষা তহবিলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'চিন্তা করুন চিকিৎসা সহায়তা, যেমন টিকাদান সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে যেসব গরীব মানুষ উপকৃত হচ্ছিল, তাদের কী হবে?'

মার্কিন সিদ্ধান্তের পর আইসিডিডিআর,বির এক হাজারেরও বেশি কর্মচারীকে ছাঁটাই করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউএসএআইডি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সম্পর্কিত প্রকল্পে সহায়তা করে, যা লাভজনক কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে না।

অনেক দরিদ্র মানুষ জীবিকা এবং আয় উৎপাদন সম্পর্কিত প্রকল্পগুলো থেকে উপকৃত হচ্ছিলেন এবং তারা এখন সমস্যার মুখে পড়বেন বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।

আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, তার সংস্থা দুটি মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছিল, যেগুলো বাতিল করতে হয়েছে। এর ফলে দুই ডজনেরও বেশি কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন।

'আমরা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ে কাজ করছিলাম। মার্কিন সরকার সবসময় শ্রম অধিকারের কথা বলে আসছে, কিন্তু এখন সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। এর অর্থ হলো নিয়োগকর্তারা শ্রমিকদের শোষণ করার আরও সুযোগ পাবে,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ইতোমধ্যে ইউএসএআইডি-অর্থায়িত প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এনজিওদের একটি ফোরামের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

'উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের বেকারত্ব সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। আমরা এনজিওগুলোকে অনুরোধ করছি যে তারা যতটা সম্ভব অন্যান্য প্রকল্পে বেকার কর্মীদের যেন অন্তর্ভুক্ত করে,' তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ইউএসএআইডি-অর্থায়িত প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করছে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো।

বেশ কয়েকজন উন্নয়নকর্মী বলেন, এনজিও কার্যক্রম কীভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে তা সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে।

একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, এনজিওগুলো এখন বিদেশি তহবিল দিয়ে যে কাজ করে, তার অনেকগুলো সরকারেরই বাস্তবায়ন করা উচিত, যেমন প্রয়োজনীয় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরবরাহ বা টিকাদান কর্মসূচি।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, 'প্রকল্পভিত্তিক কার্যক্রম বেশিরভাগ সময়েই টেকসই হয় না। অর্থায়ন বন্ধের মার্কিন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের জন্য নতুন করে শেখার এবং নিজেদের স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ হওয়া উচিত।'

'স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের জন্য আমাদের তরুণদের কর্মসংস্থান তৈরি, ব্যবসার প্রচার এবং দক্ষতা বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
political reform in Bangladesh

Pathways to a new political order

The prospects for change are not without hope in Bangladesh.

10h ago