জুলাইয়ের নিখোঁজেরা: পর্ব ২

গণহত্যার প্রকৃত মাত্রা লুকানোর চেষ্টা

আঞ্জুমানের কাকরাইল কার্যালয়ে টানানো জুলাই ও আগস্টে দাফন হওয়া ১১৪টি বেওয়ারিশ মরদেহের ছবি, যারা সবাই এখন রায়েরবাজারে শায়িত। এদের অনেকেই জুলাই গণহত্যার শিকার। ছবি: সংগৃহীত
আঞ্জুমানের কাকরাইল কার্যালয়ে টানানো জুলাই ও আগস্টে দাফন হওয়া ১১৪টি বেওয়ারিশ মরদেহের ছবি, যারা সবাই এখন রায়েরবাজারে শায়িত। এদের অনেকেই জুলাই গণহত্যার শিকার। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই অভ্যুত্থানের সাত মাস পার হয়ে গেলেও আন্দোলনকারীদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ। এরকম ৩১টি ঘটনা অনুসন্ধান করেছি আমরা—যার মধ্যে ছয়জনকে রায়েরবাজার কবরস্থানে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়েছে (বিস্তারিত পড়ুন প্রথম পর্বে)। চার পর্বের অনুসন্ধানের দ্বিতীয় পর্বে আজ পড়ুন কীভাবে গণহত্যার প্রমাণ ও হাসপাতালের নথি লুকানোর চেষ্টা করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার-

দেশব্যাপী কারফিউ ও ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে যখন সবাই বিচ্ছিন্ন, তখনও কিছু পরিবার হন্যে হয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছে তাদের বাবা, ভাই, ছেলে বা স্বামীকে খুঁজতে। এই খোঁজাখুঁজির মধ্যেই তাদের স্বজনদের 'অজ্ঞাতনামা' পরিচয়ে রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়া এই মানুষগুলোকে এক সপ্তাহের মধ্যে তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়।  

অভ্যুত্থানের সাত মাস পরও এই পরিবারগুলো জানে না রায়েরবাজারের কোন কবরে শায়িত আছেন তাদের আপনজন।

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গণহত্যার প্রকৃত মাত্রা গোপন করতেই পরিকল্পিতভাবেই লাশগুলোকে তড়িঘড়ি করে দাফনের ব্যবস্থা করেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতাহতদের হাসপাতালের নথি লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ক্ষেত্রে যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। মর্গের সূত্রমতে, হাসপাতালে যথেষ্ট জায়গা থাকলেও পুলিশের নির্দেশে দ্রুত লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের দুটি মর্গের সম্মিলিতভাবে প্রায় ১০০ লাশ রাখার ব্যবস্থা আছে, জানান মর্গ সহকারী রামু চন্দ্র দাস।

আঞ্জুমানের নথিপত্রে দেখা যায়, ৮ জুলাই দাফন করা সাত লাশের মধ্যে ছয়টিই ১০ দিনের বেশি সময় ধরে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে ছিল। (ডানে) কিন্তু, ২৪ জুলাই শাহবাগ থানা থেকে আসা আটটি মরদেহই দুইদিনের মধ্যে দাফন হয়। ছবি: সংগৃহীত
আঞ্জুমানের নথিপত্রে দেখা যায়, ৮ জুলাই দাফন করা সাত লাশের মধ্যে ছয়টিই ১০ দিনের বেশি সময় ধরে ঢামেক হাসপাতালের মর্গে ছিল। (ডানে) কিন্তু, ২৪ জুলাই শাহবাগ থানা থেকে আসা আটটি মরদেহই দুইদিনের মধ্যে দাফন হয়। ছবি: সংগৃহীত

তিনি জানান, আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে, ১৫ জুলাই এই দুই মর্গ মিলিয়ে ২৮টি লাশ ছিল।

'আমরা যেকোনো বেওয়ারিশ লাশই অন্তত সাত দিন মর্গে রাখি। অনেক লাশ এখানে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পড়ে থাকে,' বলেন রামু।   

কিন্তু শাহবাগ থানার সাধারণ ডায়েরি (জিডি), ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের রেজিস্টার ও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, ২৪ জুলাই রায়েরবাজার সমাহিত হওয়া আট আন্দোলনকারীকেই মৃত্যুর ছয়দিনের মধ্যে দাফন করা হয়েছে।

এই আটজনের মধ্যে সোহেল রানা, আসাদুল্লাহ, ফয়সাল সরকার ও রফিকুল ইসলামও আছেন (বিস্তারিত জানতে প্রথম পর্ব পড়ুন)। কিন্তু বাকি চারজনের পরিচয় এখনো অজ্ঞাত।

কেন তড়িঘড়ি করে এই লাশগুলো মর্গ থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো, জানতে চাইলে রামু বলেন, 'পুলিশের অর্ডার। আমরা চাইলে তো আরও অনেকদিন রাখতে পারতাম।'

সাধারণত, ঢামেক হাসপাতালে থাকা কোনো লাশের খোঁজ এক সপ্তাহের মধ্যে কেউ নিতে না আসলে মর্গ থেকে শাহবাগ থানায় খবর দেওয়া হয়। এরপর ময়নাতদন্তসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ করে বেওয়ারিশ লাশ দাফন হতে প্রায় এক মাস, মাঝে মাঝে এরচেয়েও বেশি সময় লাগে।

এ সংক্রান্ত বিভিন্ন নথিপত্রে এর প্রমাণ মিলেছে।

যেমন, গতবছরের ৮ জুলাই—আবু সাঈদ হত্যার আট দিন আগে—পুলিশের তত্ত্বাবধানে ঢামেক থেকে সাতটি লাশ রায়েরবাজারে দাফন করে আঞ্জুমান। তাদের মৃত্যুর তারিখ ১২ জুন থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে।

অর্থাৎ এই সাত মরদেহের ছয়টিই তিন সপ্তাহ বা তার বেশি সময় মর্গে সংরক্ষিত ছিল।

কিন্তু ২৪ জুলাই আঞ্জুমান যে আট রদেহ গ্রহণ করে, তার মধ্যে চারজনই আগের দিন মারা গেছেন। বাকি চারজন মারা গেছেন ২২ জুলাই।

গণহত্যার প্রমাণ মুছে ফেলার এবং শহীদদের পরিবারেরা যেন তাদের মরদেহ খুঁজে না পায়, এটি তা নিশ্চিত করার পরিকল্পিত প্রয়াস ছিল বলে আমাদের অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়।

দাফনের আগে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জব্বারের দায়ের করা আট সাধারণ ডায়েরি (জিডি) অনুযায়ী, ছয়জন যাত্রাবাড়ীতে এবং দুজন উত্তরায় নিহত হয়েছেন। সবার দেহেই গুলির ক্ষত পাওয়া গেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, হাসপাতালের মর্গে দীর্ঘদিন কোনো বেওয়ারিশ লাশ থাকলে তা পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ আঞ্জুমানকে জানায় এবং পুলিশের উপস্থিতিতে আঞ্জুমান মর্গ থেকে লাশ নিয়ে দাফন করে।

কিন্তু অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্তত নয়টি বেওয়ারিশ লাশের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।

নথি অনুযায়ী, শাহবাগ থানার কনস্টেবল সালাহউদ্দিন নিজে ঢামেক হাসপাতাল থেকে আটটি এবং শেরেবাংলা নগর থানার এসআই শাকিল জোয়ার্দার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অন্তত একটি লাশ গ্রহণ করেছেন।

উভয় ক্ষেত্রেই হাসপাতালে না গিয়ে সংশ্লিষ্ট দুই থানা থেকে লাশ গ্রহণ করে আঞ্জুমান।

এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সালাউদ্দিন বলেন, তিনি কেবল শাহবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাজিজুর রহমানের 'অর্ডার' পালন করেছেন। থানার আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা একই মন্তব্য করেছেন।

তবে মোস্তাজিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ঢামেক কর্তৃপক্ষ ও সালাহউদ্দিনের দাবি অনুযায়ী, আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট এই আটটি লাশই কেবল আঞ্জুমানে পাঠানো হয়েছে।

ঢামেক ছাড়াও ঢাকার ভেতর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে (মিটফোর্ড হাসপাতাল) বেওয়ারিশ লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।

তবে এই দুটি হাসপাতালই দাবি করেছে, তারা আন্দোলন-সংশ্লিষ্ট কোনো বেওয়ারিশ লাশ মর্গে রাখেনি। 

কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী, অন্তত সোহরাওয়ার্দীর এই দাবি মিথ্যা। (মিটফোর্ডের দাবি আমরা যাচাই করিনি।)

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লুকোচুরি

১৯ জুলাই আন্দোলনে যোগ দিতে বড় ভাই আব্দুল জব্বারের সঙ্গে মোহাম্মদপুর টাউন হলের সামনে আসেন মাহিন মিয়া। সেদিন জব্বার বাড়ি ফিরলেও মাহিনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দীর্ঘদিন ভাইকে খুঁজে বেড়ানো জব্বার ৫ আগস্টের পর আঞ্জুমানের কাকরাইল কার্যালয়ে টানানো শতাধিক লাশের ছবির মধ্যে ভাইকে খুঁজে পান।

নিখোঁজ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় প্রথম ও একমাত্র সন্তানের বাবা হন মাহিন। ৩ আগস্ট—এক দফা ঘোষণার দিন—এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তার স্ত্রী।

মাহিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এই পত্রিকার হাতে এসেছে।

তাকে 'অজ্ঞাতনামা' পরিচয় দিয়ে লেখা সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯ জুলাই মাথার দুই পাশে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাহিনকে পাওয়া যায়।

মাহিনের পরিবার প্রতিবেদনে থাকা ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করেছে।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের রেজিস্টার অনুযায়ী, ২০ জুলাই মাহিনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয় এবং এর মাত্র দুদিন পর শেরেবাংলা থানার এসআই শাকিল জোয়ার্দার তার লাশ নিয়ে যান।

'আমরা তো চাইলে অনেকদিন রাখতে পারতাম এই লাশ। মর্গের প্রায় ফ্রিজই ফাঁকা ছিল। কিন্তু পুলিশ তড়িঘড়ি করে নিয়ে গেল,' বলেন সোহরাওয়ার্দীর মর্গ সহকারী যতন কুমার।

এসআই শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, মাহিনের মরদেহ তিনি মর্গে দিয়ে আসলেও কখনো ফেরত নেননি। কিন্তু মর্গের রেজিস্টারে ১৯ জুলাই ময়নাতদন্তের জন্য লাশ দিয়ে আসা এবং ২২ জুলাই লাশ ফেরত নেওয়া, দুটির পাশেই আছে কেবল শাকিলের নাম। সেখানে থাকা তার ফোন নাম্বারেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করি আমরা।   

মাহিন ছাড়াও ১৭ থেকে ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে মারা যাওয়া অন্তত আরও আটটি লাশ ২২ থেকে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী থেকে রায়েরবাজারে যায়।

রায়েরবাজারের রেজিস্টার অনুযায়ী, এদের মধ্যে পাঁচজনের বয়স ২৩ থেকে ৩৫-এর মধ্যে।

এখানে একাধিক জুলাই শহীদ থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও অন্যান্য নথি না পাওয়ায় আমরা তা যাচাই করতে পারিনি।

এদিকে ঢামেক কেবল আট বেওয়ারিশ লাশ আঞ্জুমানে পাঠানোর যে দাবি জানিয়েছে, তাও নিশ্চিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

রায়েরবাজারে এক সারিতে (মাঝখানে নীল ফলক সম্বলিত) দাফন করা হয়েছে জুলাই-আগস্টের সব ‘অজ্ঞাতনামা’ লাশ। ছবি: স্টার
রায়েরবাজারে এক সারিতে (মাঝখানে নীল ফলক সম্বলিত) দাফন করা হয়েছে জুলাই-আগস্টের সব ‘অজ্ঞাতনামা’ লাশ। ছবি: স্টার

আন্দোলনে যোগ দেওয়া আহমেদ জিলানি ৩ আগস্ট মারা যান, ১৩ আগস্ট তার ময়নাতদন্ত হয়। ৩১ আগস্ট তাকে রায়েরবাজারে দাফন করা হয়।

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তার মাথার পেছনে গুলি ও ছুরিকাঘাতের দাগের কথা উল্লেখ আছে।

ময়নাতদন্ত নম্বর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢামেকের সেই আট বেওয়ারিশ লাশের তালিকায় জিলানি নেই।

গণহত্যার প্রকৃত সংখ্যা গোপন রাখতে হাসপাতালের তথ্য ও দাফনের নথি পরিকল্পিতভাবে লুকানোর এই তথ্য জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কোনো প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই হাসপাতালগুলোর মেডিকেল রেকর্ড ও সিসিটিভি ফুটেজ বাজেয়াপ্ত করেছে।'

পাশাপাশি, চিকিৎসাকর্মীদের হুমকি দিয়ে নথিপত্র লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। আইনি ভয় দেখিয়ে গুলির চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও অনেকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'দুর্ঘটনা' লিখতে বাধ্য করেছে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৮ জুলাইয়ের পর অনেকের ময়নাতদন্ত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা হয়েছে। অনেকের ময়নাতদন্ত করাই হয়নি—যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

[আগামীকাল তৃতীয় পর্বে পড়ুন কীভাবে নিহতদের পরিবারদের মরদেহ খোঁজার সময় না দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো মরদেহ লুকানোর চেষ্টা করেছে।]

Comments

The Daily Star  | English

Why is credit demand so low?

Credit demand in the private sector of Bangladesh has virtually ground to a halt, hitting its lowest level since at least 2004, indicating a distressed business and investment situation.

14h ago