বিশ্ব অপটোমেট্রি দিবস

মৌলভীবাজারে বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল: সুবিধাবঞ্চিতদের আশার আলো

প্রতিষ্ঠানটি থেকে চিকিৎসাপ্রাপ্ত ২৭ লাখ রোগীর মধ্যে ৪০ শতাংশ প্রধানত প্রান্তিক এবং তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় হাকালুকি হাওরের পাশে সাজনা বেগমের বাড়ি। নিজের বয়স বলতে পারেন না। দরিদ্র জীবনযাপন আর নানা রোগে ভুগে বয়সের চেয়েও বেশি বুড়িয়ে গেছেন।

তিনি জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে চোখে দেখতেন না। পরিবারের ওপর বোঝা হয়ে পড়েছিলেন। কোনো কাজ করতে না পারায় অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়েছে। 

সাজনা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। বিনা টাকায় অপারেশন হলো। আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুক।'

'আমার জীবন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। এখন নিজের কাজ নিজেই করতে পারি', চোখে-মুখে আনন্দ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।

সজনার এই গল্প মৌলভীবাজারের সুবিধাবঞ্চিত লাখো মানুষের একটি উদাহরণ, যারা বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যান সমিতির (বিএনএসবি) চক্ষু হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন।

ছবি: সংগৃহীত

৩৭ বছরের কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটি ২৬ লাখ ৭৬ হাজার ৮৫৪ জনেরও বেশি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে এবং সারাদেশে চক্ষু চিকিৎসার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। চোখের সমস্যায় ভোগা সব বয়সের রোগীরা প্রতিদিন এই হাসপাতালে আসেন ও চিকিৎসা নেন।

হাসপাতালের জুনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা দেওয়ান রুহুল আমিন চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একটি অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চা শ্রমিক এবং হাওরবাসীসহ সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়কে অগ্রাধিকার দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে।'

প্রতিষ্ঠানটি থেকে চিকিৎসাপ্রাপ্ত ২৭ লাখ রোগীর মধ্যে ৪০ শতাংশ প্রধানত প্রান্তিক এবং তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন। ২৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসা খরচে আংশিক ছাড় পেয়েছেন। 

রোগীরা মাত্র ১০০ টাকায় বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য নিবন্ধন করতে পারেন বলেও জানান তিনি।

১৯৭৪ সালে হাসপাতালটি প্রথম মৌলভীবাজারে চক্ষু চিকিৎসা শিবির আয়োজন শুরু করে। ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন দেশি-বিদেশি দাতাদের সহায়তায় মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে সম্প্রসারিত হয়। দূরবর্তী রোগীদের কাছে পৌঁছানোর জন্য হাসপাতালটি এখন কুলাউড়া, শায়েস্তাগঞ্জ এবং নবীগঞ্জে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছে এবং আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।

মৌলভীবাজার শহরের মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে মাতারকাপানে এই হাসপাতালটি অন্ধত্ব নির্মূল এবং দরিদ্র, অসহায় এবং সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে নির্মিত হয়েছিল। আজ হাসপাতালটি তাদের জন্য আশার আলো।

এই হাসপাতালে ১৪ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক, ৩২ জন নার্স এবং ১৪০ জন পূর্ণকালীন কর্মীর একটি নিবেদিতপ্রাণ দল রয়েছে। এর উন্নত সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে এ-স্ক্যান, বি-স্ক্যান, লেজার চিকিৎসা, ওয়ান-স্টপ ছানি অপারেশন ক্লিনিক, ডায়াবেটিক এবং গ্লুকোমা ইউনিট, একটি অকুলার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ইন্ট্রাওকুলার লেন্স পরিষেবা এবং বিশেষায়িত শিশু যত্ন। এছাড়াও, হাসপাতালের কার্যক্রম চিকিৎসার বাইরেও বিস্তৃত। চক্ষু শিবির, স্কুলের দৃষ্টি পরীক্ষা প্রোগ্রাম এবং স্কুল শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ সেশনও রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত

হাসপাতাল পরিদর্শনের সময় দেখা যায়, রোগীরা হাসপাতালে ভিড় করেছেন, বহির্বিভাগ ও অভ্যন্তরীণ বিভাগগুলোতেও ভিড় রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সৈয়দ সাহেদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চোখের সমস্যার কারণে মায়ের বিদেশযাত্রায় ঝামেলা হওয়ায় তাকে এখানে নিয়ে আসি। আমি এখানকার সেবায় সন্তুষ্ট।'

হাসপাতালের একজন সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. শাহ আমিনুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি বিশ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশে শিশু অন্ধত্বের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের শিশু বিভাগ প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। আমরা একদিন বয়সী থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের চোখের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসা করি। আমরাই কেবল সিলেট বিভাগে এই চিকিৎসা প্রদান করতে পারি এবং কেবল সিলেট বিভাগ থেকে নয়, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা থেকেও মানুষ এই চিকিৎসা নিতে আসেন।'

হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির অবৈতনিক যুগ্মসম্পাদক আব্দুল হামিদ মাহবুব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খ্যাতি এবং সম্প্রসারিত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে মৌলভীবাজারের বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের জন্য আশার আলো জোগাচ্ছে।'

সমাজ থেকে অন্ধত্ব দূরীকরণ এবং সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বর্তমানে হাসপাতালটি সাতটি সাধারণ কেবিন, ১১টি এসি কেবিন, ৩১টি সাধারণ, শিশুদের জন্য একটি শিশু ওয়ার্ড এবং ক্যাম্পে আগত রোগীদের জন্য একটি ক্যাম্প ওয়ার্ড নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল পরিচালিত হয় ১৭ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটির দিক নির্দেশনায়। জেলা প্রশাসক পদাধীকার বলে কমিটির সভাপতি। চোখের রোগীদের একটি বিরাট অংশ শিশু। এই শিশুদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০০৪ সালে অরবিস ইন্টারন্যাশনাল এবং বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট বিভাগের একমাত্র বিশেষায়িত শিশু চক্ষু বিভাগ। 

ছবি: সংগৃহীত

শুরু থেকে এ পর্যন্ত মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতালে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৭ জন রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা, ৮৮ হাজার ৭৫৮ জন রোগীকে অপারেশন করা হয়েছে। বিনামূল্যে এক হাজার ৬৬০টি চক্ষু শিবিরের মাধ্যমে সাত লাখ ৩৪ হাজার ৬২১ জন রোগীকে চিকিৎসা প্রদান এবং ৯৩ হাজার ৬৬৬ জন রোগীর অপারেশন করা হয়েছে। ৯০১টি স্কুল পরিদর্শনের মাধ্যমে দুই লাখ ৮১ হাজার ৭২৪ জন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ৪৯টি পেডিয়াট্রিক ক্যাম্পের মাধ্যমে ২০ হাজার ৬৬৮ জন শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। 

প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ 'প্রতিবন্ধিতা উত্তরণ সম্মাননা-২০১৮'-এ ভূষিত হয়েছে মৌলভীবাজারের এই চক্ষু হাসপাতালটি। 

বাংলাদেশে অন্ধ শিশুদের সহায়তায় ভিশন ফর বাংলাদেশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অপারেশন ম্যানেজার রাচেল অ্যান্ড্রুজ তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, মৌলভীবাজার বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল বাংলাদেশের সেরা চক্ষু হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি। এর কর্মীরা পেশাদার, নিবেদিতপ্রাণ এবং ছানি এবং অন্যান্য অনেক চক্ষু সংক্রান্ত রোগের কারণে অন্ধত্ব দূর করার ক্ষেত্রে দক্ষ। বিএনএসবি তার সর্বোত্তম পর্যায়ে সমাজের দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চোখে অস্ত্রোপচারসহ বিভিন্ন চিকিৎসা প্রদান করে আসছে।

তিনি আরও লিখেছেন, চক্ষু শিবির এবং আউটরিচ ক্লিনিকের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা সেইসব রোগীদের কাছে পৌঁছে যায় সহজে। বিএনএসবির কাজ অসাধারণ... বিশেষ করে বাংলাদেশের শিশুদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করে।

Comments

The Daily Star  | English

Tribunal-2 to be formed to expedite trials: ICT Adviser

Alam did not elaborate on the specific legal amendments or timeline for the formation of the new tribunal

52m ago