জুনে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে: প্রধান উপদেষ্টা

জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: টেলিভিশন লাইভ থেকে নেওয়া

ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে উল্লেখ করে আগামী জুনের মধ্যে এটি আট শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ আশা ব্যক্ত করেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'আজ ২৫শে মার্চ, মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত এক হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরপরাধ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করেছে। ২৫শে মার্চ থেকেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।' 

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, 'নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতিত নারীর আত্মত্যাগ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্ম দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই বীরদের প্রতি আমার সালাম।'

'সেইসঙ্গে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হাজারো শহীদ ও আহত, যারা বৈষম্য, শোষণ, নির্যাতন এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রতি সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে আমি সশ্রদ্ধ সালাম জানাচ্ছি। জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদেরকে যে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে চাই,' বলেন তিনি।

ড. ইউনূস বলেন, 'পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা উপলক্ষে আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে, সকলকে জানাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। এবারের ঈদ স্মরণীয়ভাবে আনন্দদায়ক হোক এই কামনা করছি।'

'বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জোর ব্যবস্থা নিয়েছে' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রমজান ও ঈদে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জিনিসপত্রের দামের লাগাম টেনে ধরা, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ রমজানে যাতে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে না যায় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।' 

'রমজান মাসজুড়ে সরবরাহ চেইনের প্রতিবন্ধকতা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। দেশের সকল জায়গা থেকে খবর এসেছে যে, এই রমজানে দ্রব্যমূল্য আগের তুলনায় কমেছে; জনগণ স্বস্তি পেয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে এই প্রচেষ্টা চলমান থাকবে,' যোগ করেন তিনি।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা যে ভয়াবহ লুটপাট কায়েম করেছিল; আপনারা সেটার ভুক্তভোগী ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে তারা পালিয়ে যাবার সময় এক লন্ডভন্ড অর্থনীতি রেখে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেবার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির অপরাপর সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করছে। এ সরকারের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগামী জুনের মধ্যে এটি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করছি।'

তিনি আরও বলেন, 'দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রেমিট্যান্স ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড গড়েছে, প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আমাদের দেশের অর্থনীতি গড়ার বীর সৈনিক। তাদের জন্য প্রক্রিয়াগত যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো সহজ করে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। তারা যেন ভোগান্তির শিকার না হন, দূতাবাস যেন ঠিকমতো কাজ করে, এটি নিশ্চিত করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আগামী নির্বাচনে যেন তাদের ভোটাধিকার দিতে পারি সেজন্য কাজ করছি।'

'পলাতক সরকারের আমলে চর দখলের মতো দেশের ব্যাংকগুলি দখল করে নেওয়া হয়েছিল' মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, 'আমানতকারীর টাকাকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত টাকায় রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কাজ ছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করে নিয়ম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, হিসাবপত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করা।' 

'ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্জনগুলির মধ্যে এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ,' যোগ করেন তিনি। 

তিনি আরও বলেন, 'গত সরকারের লুটপাটের মহোৎসবে গত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে- এটা আমরা জানি। কত রকমভাবে পাচার হয়েছে তাও জানার বিষয়। অভিনব একেকটা পদ্ধতি ছিল। পাচারের একটা পদ্ধতি সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছে। এই পাচার হয়েছে - বিদেশে অধ্যয়নরত সন্তানের কাছে টাকা পাঠানোর নামে। তিনি সন্তানের লেখাপড়ার জন্য এক সেমিস্টারের অর্থাৎ তিন মাসের খরচ বাবদ অফিসিয়াল ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠিয়েছেন তিন কোটি ৩৩ লক্ষ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। পাচারের এর চাইতে বেশি তাক লাগানো পন্থা আর কী আছে তার কোনো সীমা আছে বলে আমার মনে হয় না। আইন, নিয়ম, নীতির জায়গায় যখন হরিলুট প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এমন সবকিছুই সম্ভব। এই অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।'

'অন্তর্বর্তী সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বিষয়ে খুবই আগ্রহী। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে দেশে নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আপনারা দেখতে পাবেন,' যোগ করেন তিনি। 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশে রপ্তানি ১৩ শতাংশ বেড়েছে। জানুয়ারিতে ৭ শতাংশ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বেড়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে লাইসেন্সিং রিকোয়ারমেন্টস, প্রত্যাবাসন আইনসহ বিনিয়োগকারীদের যে সাধারণ সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধানে কাজ শুরু করেছে।'

তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আগামী মাসে ঢাকায় চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন করছে, বিশ্বখ্যাত অনেক বিনিয়োগকারী এতে অংশ নেবেন। ইতোমধ্যেই ডিপি ওয়ার্ল্ড, সিঙ্গাপুর পিএসএ, এপি মোলার মারস্ক কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীর সকল সরকার আমাদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।'

'এটা শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের বার্ষিক বৈঠকে। আপনাদের মনে আছে বিশ্বের সরকার প্রধানরা কীভাবে আমাদের সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে দেখা করতে এগিয়ে এসেছে। তারপর থেকে যেকোনো সম্মেলনে গিয়েছি, দেখেছি আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের আগ্রহ কীভাবে ক্রমেই বেড়ে চলেছে,' যোগ করেন তিনি।

জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসের সম্মেলনের উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, 'এই সম্মেলনে ৪৭টি পৃথক ইভেন্টে আমার অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, বিশ্ব বাণিজ্যের নায়করা, জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাঁরা আমাদের পাশে থাকার জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেছে।'

'সম্প্রতি আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়েছিলাম। তারা বিগত সরকারের সময় আমাদের ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা সে দেশের ভিসার দরজা খোলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।  তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন তাদের দিক থেকে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ভিসার দরজা উন্মুক্ত করবেন। আমি আশা করছি সেটা দ্রুতই উন্মুক্ত হবে,' বলেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'আমি সংযুক্ত আরব আমিরাতকে আমাদের দেশে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য একটি শিল্পাঞ্চল করার প্রস্তাব দিয়েছি। তারা এই বিষয়ে আগ্রহ জানিয়েছে। শিল্প অঞ্চলে দুটি কাজ দিয়ে তারা শুরু করবে। এজন্য কথাবার্তা শুরু হয়েছে। প্রথমে মুসলিম বিশ্বে সরবরাহের জন্য একটি হালাল গোশত প্রক্রিয়াজাত করার কারখানা করবে। এরপর মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কারখানা স্থাপন করবে। তারা আমাদের নতুন সামুদ্রিক বন্দর পরিচালনা করার জন্যও আগ্রহ জানিয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English
Apparel Buyers Delay Price Increases Post-Wage Hike Promise

Garment exports to US grow 17%

Bangladesh shipped apparels worth $5.74 billion in the July-March period to the USA

2h ago