জামদানি পল্লিতে ব্যস্ত তাঁতঘর, দোকানে ‘বিক্রি কম’

জামদানি শাড়িতে নকশা তুলছেন তাঁতশিল্পী। ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের জামদানি পল্লিতে ঈদের আগে তাঁতীদের ব্যস্ততা বাড়লেও, বিক্রি কম থাকায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছর ধরে ঈদের আগে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে দাবি তাদের।

রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে অবস্থান বিসিক জামদানি শিল্পনগরীর। স্থানীয়দের কাছে এটি জামদানি পল্লি নামেই বেশি পরিচিত। ঢাকাই মসলিনের হাত ধরে এ অঞ্চলে জামদানির আগমন। জামদানি শিল্পকে এগিয়ে নিতে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০ একর জমির উপর এ শিল্পনগরের কার্যক্রম শুরু হয়। যদিও উদ্যোগ ছিল নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই।

বিসিকের জামদানি শিল্পনগরীর কর্মকর্তারা জানান, পুরো শিল্পনগরীতে ৪০৭টা প্লট আছে। প্রতি প্লটে অন্তত চারটা করে তাঁত আছে। এখানে প্রায় এক হাজার ৬০০ তাঁতী নিয়মিত জামদানি শাড়ি তৈরি করেন।

গত শুক্রবার ছুটির দিনের সকালে জামদানি পল্লিতে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতা সমাগম ছিল একেবারেই কম। প্রতি শুক্রবার ভোর থেকে এ পল্লিতে জামদানির হাট বসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসেন জামদানি শাড়ি কিনতে। খুচরা ক্রেতারাও ভিড় জমান। উৎসবের মৌসুম ছাড়াও এ হাট বেশ জমজমাট থাকে বলে জানালেন স্থানীয়রা। তবে, গত হাটের চিত্র ছিল ভিন্ন। ক্রেতা সমাগম কম থাকায় সকাল আটটার আগেই হাট মিলিয়ে যায়।

নয়টার দিকে হাটে মাত্র তিনজন বিক্রেতাকে জামদানি শাড়ি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। কথা হলে তারা বলেন, এবার ঈদের আগে বাজার একেবারেই মন্দা।

হাট কমিটির সদস্য কামরুল হাসান বলেন, 'ঈদের আগে হাটে ক্রেতা সমাগম এত কম আর কোনো বছর দেখি নাই।'

জামদানি পল্লির প্রবেশমুখেই আয়েশা জামদানি হাউস। দোকানের ভেতরে মেঝেতে বাহারি রঙের ও নকশার শাড়ি ছড়িয়ে একাই বসে আছেন মালিক জাহিদ হাসান জুয়েল। জামদানি শিল্পের সাথে তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে জড়িত আছেন তিনি। নিজের তাঁতে তৈরি শাড়ি ছাড়াও অন্য তাঁত থেকেও শাড়ি কিনে তুলেছেন দোকানে। তবে, আশানুরূপ বিক্রি নেই বলে মন ভার তার।

'সামনে ঈদ, পহেলা বৈশাখ; কিন্তু বিক্রি একেবারেই কম। এবার রমজান মাসে ৩০ লাখ টাকা বিক্রির টার্গেট রেখেছিলাম। এখন পর্যন্ত ৩ লাখের মতো বিক্রি করতে পেরেছি। আজকে একটা ছুটির দিন কিন্তু কোনো কাস্টমার নাই,' বলেন জাহিদ।

প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তার দোকানে অবস্থান করেও কোনো ক্রেতার দেখা মেলেনি। এ প্রতিবেদক অন্তত নয়জন জামদানি শাড়ি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সবার মুখেই জাহিদের মতো হতাশার সুর।

একটি দোকানে শাড়ির দরদাম করতে দেখা গেল দুই নারীকে। রেহানা পারভীন নামে তাদের একজন বলেন, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তার ননদের বিয়ে। তাকে উপহার হিসেবে জামদানি শাড়ি দেবেন বলে এখানে আসা।

তবে, ঈদের বাজার মন্দা হওয়ার পেছনে এক ধরনের ব্যাখ্যা দিলেন নকশী জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক সহিম হাসান। তার নিজের ৩০টি তাঁতে ৬০ জন কারিগর কাজ করেন। তার কাছে অধিকাংশ শাড়িই ৮০ থেকে ১০০ কাউন্টের বোনা। যেগুলোর দাম শুরুই হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে। নোয়াপাড়ার বাসিন্দা সহিমের দাদা নোয়াব আলীও ছিলেন জামদানির কারিগর। তার হাত ধরেই এ ব্যবসায় এসেছেন তারা।

সহিম বলেন, 'জামদানি শাড়ির ক্রেতারা কিন্তু উচ্চ মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন। তারা কিন্তু ঈদে জামদানি কেনেন, ব্যাপারটা এমন না। বরং ঈদের সময় জামদানি নিয়ে তাদের চাহিদা কম থাকে। সে কারণে ঈদের বাজারের সাথে জামদানি পল্লির বিক্রির তুলনা করলে চলবে না।'

'তাছাড়া, দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জামদানির ক্রেতারা এমুখো কম হচ্ছেন বলেও মনে করেন এ জামদানি ব্যবসায়ী।

তবে, তারও যে লক্ষ্য অনুযায়ী বিক্রি কম, কথাটি জানাতেও ভোলেননি। তিনি বলেন, 'মিনিমাম ২৫ লাখ টাকার বিজনেস করার কথা ছিল। কিন্তু তার চার ভাগের এক ভাগও বিক্রি হয়নি।'

যদিও, বিক্রেতাদের এই পরিস্থিতির সাথে মিল নেই তাঁতঘরে ব্যস্ত কারিগরদের। কথা বলারও ফুরসত নেই তাদের। এত ব্যস্ততার মাঝেও কথা হয় কয়েকজন জামদানি কারিগরের সঙ্গে।

জামদানি পল্লিতে শাড়ি বুনছেন তাঁতীরা। ছবি: স্টার

লাল রঙের সুতোয় তৈরি শাড়ির উপর সোনালী নকশা ফুঁটিয়ে তুলছিলেন ২৫ বছর বয়সী যুবক মো. হাসান। চাঁদপুরের এ বাসিন্দা ১২ বছর বয়স থেকেই জামদানি শাড়ি বুনতে পারেন। তিনি যে শাড়িটি বুনছিলেন সেটি ৮০ কাউন্টের বলে জানালেন। এটি শেষ করতে তার আরও ৪ দিন সময় লাগবে।

কাজ করতে করতে হাসান বলেন, 'আজ শুক্রবার কিন্তু কাজের চাপ বেশি থাকায় অর্ধেক বেলা কাজ করছি। আমাদের আসলে ঈদ বা উৎসব বলতে কিছু নাই। মহাজনের কাছে সারাবছর অর্ডার আসতেই থাকে। তাছাড়া, একটা শাড়ি বুনতে অনেক সময় এক মাসেরও বেশি সময় লাগে। দোকানের বিক্রির সাথে আমাগো কাজের ব্যস্ততার কোনো সম্পর্ক নাই। আমাগো সারাবছরই কাজ থাকে।'

পল্লির ২ নম্বর গলিতে একটি তাঁতে কাজ করছিলেন ৫০ বছর বয়সী মোবারক হোসেন। ২০ বছর ধরে জামদানি শাড়ি বুননের কাজে জড়িত এ কারিগর বলেন, 'কাজের চাপ অনেক। বেচাকেনার কথা তো কইতে পারে মহাজন।'

তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সুতার কাউন্ট অনুযায়ী জামদানির মান ও দাম নির্ধারিত হয়। কাউন্ট যত বেশি সুতা তত চিকন এবং সেই সুতার তৈরি শাড়ির দামও তত বেশি। শাড়ির উপর নকশাও দামের তারতম্য নির্ধারণ করে। এই পল্লিতে ৩০ থেকে ১০০ কাউন্টের জামদানি তৈরি হয়। জামদানি শাড়ি ছাড়াও পুরুষদের পাঞ্জাবি ও নারীদের থ্রি-পিছও বিক্রি হয় এখানে।

জামদানি পল্লির দোকানগুলোতে বিক্রি কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ছবি: স্টার

জামদানির বিক্রেতারা বলছেন, পহেলা বৈশাখ ও ঈদ- বড় এই দুই উৎসব সামনে থাকলেও আশানুরূপ বিক্রি নেই। বরং অন্যান্য সময়গুলোতেও এর চেয়ে ভালো বিক্রি থাকে বলে দাবি তাদের।

পল্লিতে থাকা নিজের দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও জামদানি বিক্রি করেন ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন। 'অফলাইন ও অনলাইন' উভয় স্থানেই বিক্রি কম বলে জানান তিনি।

জামদানি বিক্রি কম থাকায় সুতার বিক্রিও কম বলে জানালেন রাজু শেখ নামে এক সুতা সরবরাহকারী।

রাজধানীর গুলশানে জামদানি শাড়ি বিক্রির দোকান রয়েছে মো. সাকিবের। দোকানে বিক্রির জন্য পাইকারি দরে জামদানি কিনতে আসা এ ব্যবসায়ী বলেন, 'ঈদে অন্যান্য পোশাকের চাহিদা বেশি থাকলেও জামদানির চাহিদা থাকে কম। কেননা, জামদানির দাম বেশি। মূলত এটি একটি শৌখিন পোশাক। আর তাছাড়া, দেশের পরিস্থিতির কারণেও হয়তো এবার চাহিদা আরও কম।'

Comments

The Daily Star  | English

Harvard sees $2.2 billion in funding frozen after defying Trump

Elite US university Harvard was hit with a $2.2 billion freeze in federal funding Monday after rejecting a list of sweeping demands that the White House said was intended to crack down on campus anti-Semitism

3h ago