যেভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু

ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ

বাংলা পঞ্জিকার ইতিহাস বেশ পুরোনো হলেও বাংলা নববর্ষ উদযাপন বা পয়লা বৈশাখ সাধারণ উৎসবে পরিণত হওয়ার ঘটনা তুলনামূলকভাবে নতুন। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরুর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তা আরও বিকশিত হয়।

তবে এই অঞ্চলে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ইতিহাস আরও অনেক পুরোনো। যত দূর জানা যায়, এখানে পয়লা বৈশাখের প্রথম অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৫১ সালে।  আয়োজক ছিল একটি 'লেখক-শিল্পী-মজলিশ' নামের সংগঠন, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত কিছু শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও সাংবাদিক।

বিখ্যাত সম্পাদক ও সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী (১৯২২-১৯৮০) তার  'দরবার-ই-জহুর' বইতে নববর্ষ উদযাপনের একটি প্রাণবন্ত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি স্মরণ করেন, ১৯৫১ সালে লেখক-শিল্পী-মজলিশের আয়োজকেরা ঢাকা শহরের ওয়ারী, ৭ হেয়ার স্ট্রিটে অবস্থিত মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। উদ্দেশ্য ছিল বাংলা নববর্ষকে সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। সেই আয়োজন নিতান্তই সাধারণ এবং মঞ্চসজ্জা অতি সাদামাটা হলেও জনসমাগম ছিল বেশ ভালো। অনুষ্ঠানের খরচ সংগ্রহ করা হয়েছিল গণচাঁদার মাধ্যমে। ছাপানো হয়েছিল একটি রসিদ বই। চাঁদা হিসেবে কেউ দিয়েছিল এক টাকা কেউ দিয়েছিল পাঁচ টাকা। মোট ৭০০-৮০০ টাকার মতো অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল, যা সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্যই বলা যায়।

জহুর হোসেন নববর্ষের একটি ঘটনা স্মরণ করেছেন, যা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের পরিচালক মাহমুদ হোসেনের কাছে গিয়েছিলেন। সেদিন তার কক্ষে একজন জাঁদরেল আইসিএস কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন, এক্সাইজ কমিশনার ওয়াজির আলী শেখ। তিনি ছিলেন পাঞ্জাবের উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষ।

বাংলা নববর্ষের জন্য অর্থ সংগ্রহের কথা শোনে ওয়াজির আলী শেখ তাচ্ছিল্যভরে মন্তব্য করেছিলেন, 'বৈশাখ তো শিখরা উদযাপন করে'। প্রতিক্রিয়ায় জহুর হোসেন এবং তার সঙ্গীরা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, 'এটি আমাদের নববর্ষ। আমাদের জানার প্রয়োজন নেই শিখ সম্প্রদায় বৈশাখ উদযাপন করে কিনা। তাছাড়া, বাংলা পঞ্জিকা তো মুঘল শাসকরাই কৃষি কাজে সহায়তা করার জন্য চালু করেছিল।' এর পরও ওয়াজির আলী শেখ যুক্তি মেনে নেননি। জহুর হোসেনের মতে, এই মতবাদ ছিল আসলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বাংলার ঐতিহ্যের প্রতি নিদারুণ নির্লিপ্ততা এবং সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ।

জহুর হোসেনের তথ্যমতে, ১৯৫১ সালে নববর্ষ উদযাপনের মঞ্চে অন্যান্যদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক না থাকলেও, বাংলা সংস্কৃতির  প্রতি অঙ্গীকারের কারণে তারা তাতে অংশ নিয়ে ছিলেন। বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে নববর্ষের এই আয়োজনে অংশ নিতে তারা তাগিদ বোধ করেছিলেন। কারণ এই উদযাপনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বরূপ সন্ধানের সূচনা প্রতীকীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৫১ সালে নববর্ষের প্রথম উদযাপন আরেকটি কারণেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই এই নববর্ষ উদযাপন হয়েছিল। অনেকে ২১ ফেব্রুয়ারিকে বাংলা জাতীয়তাবাদের সূচনা বিন্দু বলে থাকেন।

জহুর হোসেন লিখেছেন, পরবর্তী সময়ে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সময় তিনি ১৯৫১ সালের উদযাপনে অংশগ্রহণকারী উল্লিখিত তিন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে সব সময় স্মরণ করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা শহীদ হন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধে শহীদ হওয়া মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৫৩ সালে মিলাত পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি পয়লা বৈশাখকে সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি তোলেন। এই দাবিটি নানা কারণে আকর্ষণী ছিল। কারণ ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবিতেও এটি ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকে পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশে সরকারি ছুটি হিসেবে চালু আছে।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিকথায় লেখক-শিল্পী-মজলিশ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ঢাকায় চলে আসার পর এই সংগঠনের কর্মসূচির মাধ্যমে তার সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। স্মৃতিকথায় তিনি পূর্ববর্তী কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের কথাও উল্লেখ করেছেন। এসব সংগঠনের মধ্যে প্রগতি লেখক সংঘ বা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের দমনমূলক পরিবেশের মধ্যে এসব সংগঠন ঠিকমতো নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারেনি বলে মনে করেন আনিসুজ্জামান।

এই সময়ে আরেকটি সংগঠন গড়ে ওঠে, যার সভাপতি  ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। সরদার ফজলুল করিমকে কারাগারে পাঠানো হলে ওই সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওই পরিস্থিতিতেই লেখক-শিল্পী-মজলিশ সেই সংগঠনের উত্তরসূরি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আনিসুজ্জামান লিখেছেন, লেখক-শিল্পী-মজলিশ সম্ভবত ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে কাজী মোতাহার হোসেন, অজিত কুমার গুহ এবং অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন।

আনিসুজ্জামান স্মরণ করেন,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অমিয় ভূষণ চক্রবর্তী লেখক-শিল্পী-মজলিশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। তবে সংগঠনটির সভাপতির নাম আনিসুজ্জামান স্মরণ করতে পারেননি।

লেখক-শিল্পী-মজলিশ পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি ২৫ বৈশাখ উদযাপনও এই দেশে শুরু করেছিল বলে জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁর 'দরবার-ই-জহুর' বইতে উল্লেখ করেছেন। তবে আনিসুজ্জামানের মতে, লেখক-শিল্পী-মজলিশের দ্বারা মূলত রবীন্দ্র এবং নজরুল জয়ন্তী আয়োজিত হতো। আবার তারা কবি ইকবালের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেও অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। ১৯৫০ সালে লেখক-শিল্পী-মজলিশের আয়োজনে রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠানে মুনীর চৌধুরী 'সাধারণ মেয়ে' নামের একটা কবিতার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হওয়ার কথা স্মরণ করেছেন আনিসুজ্জামান।

১৯৫১ সালের নববর্ষ উদযাপনের কথা স্মরণ করে জহুর হোসেন বলেন, ওই অনুষ্ঠানে একটি ছয় বছর বয়সী মেয়ে নৃত্য পরিবেশন করেছিল। পরে একজন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ওই নৃত্যকে অশ্লীল উল্লেখ করে আয়োজকদের তীব্র সমালোচনা করে সংবাদপত্রে লিখেছেন। জহুর হোসেনর মতে, এসব সমালোচনা সত্ত্বেও এই উদযাপনটির ফলেই দেশের অন্যান্য স্থানেও ধীরে ধীরে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের সূচনা ঘটেছিল।

১৯৭৯ সালের এই লেখায়  জহুর হোসেন চৌধুরী অকপটভাবে স্বীকার করেছেন, ১৯৫১ সালে প্রথম পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু করার সময় বাংলাদেশের উদ্ভবকে লক্ষ্য করে তারা এসব করেননি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেই বাংলা সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এর স্বীকৃতি অর্জন। যেহেতু পাকিস্তান সেদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদ দমন করতে চেয়েছিল, তাই সেটিই পাকিস্তানের কাল হয়ে দাঁড়াল।

Comments

The Daily Star  | English

Is the US winning under Donald 'Tariff' Trump?

President Trump has now been president for almost 100 days.

3h ago