মুক্ত গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়

আলোচনায় সভায় বক্তারা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং সার্বিকভাবে গণমাধ্যমের পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছায়নি। বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে গণমাধ্যমকে চাপে রাখা হয়েছিল। এখন সেই অবস্থা থেকে মুক্তি মিললেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েই গেছে। কিন্তু রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা অত্যাবশ্যক। ফলে আগামীতে যাতে দেশে অবাধে মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চা করা যায়, সেই আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করেছেন সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভার বক্তারা।

'বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫' উপলক্ষ্যে আজ রোববার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ।

'বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, আছে ও ভবিষ্যতে থাকবে'

অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'আমার কীভাবে কথা বলব, তারপর সেটা কীভাবে গণমাধ্যমে ছাপবে, সেটা আমরা যারা রাজনীতি করি তাদের জন্য সত্যিই একটা চিন্তার বিষয়। কারণ, ইদানীং চরিত্র হরণ করার যে প্রবণতা, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তাতে চিন্তিত না হয়ে উপায় নেই।'

বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টা নতুন নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সমস্যাটা দেখা দেয় তখনই, যখন দেখি, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম একটা গোষ্ঠী হয়ে গেছে এবং তারা আরেকটা গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। কোনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও সেটার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন কর্মসূচি প্রদান করে।'

'আমরা পুরোনো মানুষ। আমরা গণতন্ত্র বলতে বুঝি যে, সবার কথা বলার স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, নিজের বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং অন্যের বিশ্বাসের স্বাধীনতায় মর্যাদা দেওয়া ও সহনশীল থাকাকে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে বুঝি, সংবাদপত্র যা বলতে চাইবে সেটা গ্রহণ করা বা পছন্দ না হলে সেটা সম্পর্কে কথা বলা। কিন্তু সেই গণমাধ্যমটাকে উড়িয়ে দেওয়া, গুড়িয়ে দেওয়া, তার প্রতি আপনার মব জাস্টিস প্রয়োগ করার চেষ্টা করা—এগুলোকে গণতন্ত্র হিসেবে দেখতে পারি না।'

মির্জা ফখরুল বলেন, 'বিএনপি প্রথম দল, যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করেছে ১৯৭৫ সালে। তার আগে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল ছিল, সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব বন্ধ ছিল।'

তিনি বলেন, 'বলছি না যে আমরা ধোয়া তুলসী পাতা। কিন্তু আমরা নিঃসন্দেহে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছি। আমাদের সময়ে সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন তুলনামূলকভাবে নিঃসন্দেহে অনেক কম হয়েছে।'

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: পলাশ খান/স্টার

মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে তারেক রহমানের ফেসবুক পোস্টের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এটা মুক্ত সংবাদমাধ্যমের সাধিত চর্চার জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা।'

বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাহলে চিন্তা-ভাবনাগুলোকে গণতান্ত্রিক করতে হবে। আমি যা বলব সেটাই সঠিক—তাহলে তো ঠিকভাবে গণতন্ত্রকে চর্চা করতে আমি সক্ষম হব না। একইভাবে সংবাদমাধ্যমগুলো আমার কথা বললে ঠিক আছে, আর আমার কথা না বললে ঠিক নেই—এই চিন্তাভাবনা গণতান্ত্রিক চর্চার নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম ভাবছে, তারা যা বলছে সেটাই সঠিক, ওটার বাইরে কেউ বললে হয়ে যাচ্ছে দোসর বা ভারতীয় দোসর বা আওয়ামী লীগের দোসর।'

এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব।

তরুণ প্রজন্মের বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমি আনন্দিত ও আশাবাদী যে তরুণদের ছাড়া কোনো কিছু এগোয় না। এটা মাথায় রাখা জরুরি। তা না হলে এই যে হাজারো ছাত্র-জনতা-শিশু প্রাণ দিলো, ১৫ বছর ধরে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ নির্যাতনে ভুগলো গণতন্ত্রের জন্য—তার পুরোটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।'

'আমরা নির্দ্বিধায়, দৃঢ়চিত্তে স্পষ্ট করে বলতে পারি, আমরা বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতে থাকবো—সরকারে থাকি আর না থাকি। আমরা নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনাদের প্রতি যে নির্যাতন হয়েছে, এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, আমরা কখনোই অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপারটা সমর্থন করবো না। আমরা আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেবো।'

মাহমুদুর রহমান মান্না। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'সংবাদমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত, কিন্তু সিলিং থাকতে হবে'

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'চীনা পার্টির অভিজ্ঞতা আপনাদের হয়তো মনে আছে, ওরা বলেছিল, শতফুল ফুটতে দাও। তারপরে ওরাই আবার পরিবর্তন করে বলেছিল শতফুল ফুটতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে যেন আগাছা না হয়, কাটা না বেড়ে যায় সেটা দেখতে হবে।'

তিনি বলেন, 'ওই পাড়ে বসে শেখ হাসিনা প্রতিদিন বিবৃতি দেন, আজকাল গ্রুপ বৈঠক করেন অনলাইনে। এই সরকার সেটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা দেখিনি। এরকম চলতে দেওয়া কি ভালো হচ্ছে? আমার কাছে মনে হয় না। আবার অবাধ তথ্যের চর্চা বন্ধ করবেন, সেটাও কি হতে পারে?'

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার সবগুলো কেন এখনো তোলা হয়নি সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'অবাধ ও মুক্ত সাংবাদিকতা যদি চান, তার মানে কোনো ব্যাপারে কোনো যন্ত্রণা করতে পারবেন না।'

মান্না বলেন, 'আমি মনে করি, অবাধ তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু সেটার একটা সিলিং থাকতে হবে। কারণ, দেশ আছে, দেশের স্বাধীনতা আছে, সার্বভৌমত্ব আছে। দেশের অনেক কিছুই আছে যেটা দেশের মতোই হবে, অন্যের মতো নয়।'

জোনায়েদ সাকি। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'কিছু গণমাধ্যম গোষ্ঠী স্বার্থের সেবা করার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে'

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, 'ন্যূনতম একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে সেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের অঙ্গীকার আছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বোচ্চ লড়াইটা করব।'

তিনি বলেন, 'গণমাধ্যম মুক্ত হওয়ার অর্থ কী? স্বাধীনতা কিংবা মুক্তি মানে কি কোনোরকমের শর্ত নিরপেক্ষ? এই প্রশ্নটি আমাদের বারবার করা দরকার এবং উত্তরটাও নিশ্চিত হওয়া দরকার। ব্যক্তির স্বাধীনতা মানে সে অন্যের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। অর্থাৎ শর্ত আছে। একইভাবে গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে। গণমাধ্যমের মালিকানা আছে, গণমাধ্যম পরিচালনাকারী সাংবাদিকরা আছে—প্রত্যেকেরই জবাবদিহি দরকার। জবাবদিহি ছাড়া কোনোপক্ষ যদি তৈরি হয়, তাহলে সেখানে নিশ্চিতভাবে স্বেচ্ছাচারিতা হবে এবং অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে দেখেছি গোষ্ঠী স্বার্থের সেবা করার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। সেটা বন্ধ হওয়া দরকার। ফলে সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দাবি উঠেছে যে গণমাধ্যমের মালিকানা কীভাবে নির্ধারিত হবে। গণমাধ্যমের মালিকানার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যাতে সেটা একচেটিয়া স্বার্থের সেবক হিসেবে না দাঁড়ায়।'

দেশের কিছু আইন বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহারের সুবিধার্থে তৈরি করা হয় উল্লেখ করে সাকি বলেন, 'গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি অনেক আইনের কীভাবে সিলেক্টিভ ব্যবহার হয়েছে। ফলে আমাদের প্রধান বিবেচনার বিষয়, রাষ্ট্র এমন কোনো আইনই করতে পারবে না যে আইনের জায়গায় কোনো না কোনোভাবে সে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে।'

সাংবাদিকদের জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিলাম বলে আমরা মব আক্রমণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছি—এটা যারা মনে করেন, তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস হবে। এ প্রবণতা যাদের আছে, তারা মোটেই গণতন্ত্রের পক্ষের মানুষ নন। এটা হাসিনাগিরি। গণতন্ত্র রক্ষা করা মানে ফ্যাসিবাদী একজনের বিরুদ্ধে লড়াই করা নয়, যেকোনো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা।'

নাহিদ ইসলাম। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ অনেক কমেছে'

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরেই মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষায় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো লড়াই করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৬ ধাপ এগিয়েছে। এটি সুখবর হলেও আমাদের আকাঙ্ক্ষা আরও বেশি ছিল।'

তিনি বলেন, 'বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট শাসনামলে যেসব প্রতিষ্ঠানের দলীয়করণ ও ফ্যাসিজম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, গণমাধ্যমও তার একটি। গণমাধ্যমের ওপরে হস্তক্ষেপের যেমন আইনি দিক আছে, তেমনি সাংস্কৃতিক দিকও আছে। ফলে, গণমাধ্যমের ভেতরে যে ফ্যাসিজম প্রবেশ করেছে, সেটা কীভাবে বের করতে পারব তার জন্য স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। কারণ, আমরা দেখছি যে ফ্যাসিজমের সঙ্গে যে মিডিয়াগুলোর সম্পর্ক ছিল, তারা যদি সেই আদর্শিক আধিপত্য থেকে বের না হয় তাহলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা যে মুক্ত গণমাধ্যম প্রত্যাশা করি, সেটা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হবে না।'

গণমাধ্যম কর্মীদের 'আরও সচেতন ও পেশাদার' হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'দল হিসেবে বা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আমরা বিভিন্ন সময় এর ভিক্টিম হয়েছি এবং হচ্ছি। মিডিয়া একটা রাজনৈতিক মেরুকরণের চেষ্টার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে।'

তিনি বলেন, 'মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিশ্রুতি আমরা সকলেই দিচ্ছি এবং সেটা আরও কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আরও খোলামেলা আলোচনা করতে পারি, রূপরেখা তৈরি করতে পারি।'

স্বচ্ছতার জন্য রাজনীতিবিদদের মতো গণমাধ্যমকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

'জাতীয় নাগরিক পার্টি মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে এবং আমরা বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র চর্চার জন্য, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য মুক্ত গণমাধ্যম অতি গুরুত্বপূর্ণ,' যোগ করেন তিনি।

তথ্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, 'বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ অনেক কমেছে বলে আমি মনে করি। অন্তত আমার সময়ে গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ একেবারে কম ছিল। কিন্তু সামাজিক আন্দোলনের চাপ তৈরি হয়েছিল গণমাধ্যমের ওপর। সেই চাপগুলো কেন বিশেষ বিশেষ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে হয়েছিল, সেটিও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, 'একইসঙ্গে গণমাধ্যমের বিগত সময়ের ভূমিকা বা ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে আমরা অনেক সময় বলেছি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা মুক্ত গণমাধ্যমের বিপক্ষে। বরং গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে, মুক্তভাবে জনগণের পক্ষে কথা বলতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এসব বক্তব্য দেওয়া।'

নূরুল কবির। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'আগামীতে ক্ষমতায় যারা আসবেন যেন মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন'

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালনের মাঝে পার্থক্যটা উল্লেখযোগ্য।

তার মতে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দরকার, এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আগামী দিনে যারা রাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসবেন, তারা যেন মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকেন, সেই প্রত্যাশা জানান তিনি।

মতিউর রহমান চৌধুরী। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সেখানে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি'

মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, 'যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সেই দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। আমি জানি না, এর জন্য কাকে দায়ী করবো। সরকার, মালিক, সাংবাদিক ইউনিয়ন বা সম্পাদক পরিষদ—আমি মনে করি আমরা ব্যর্থ হয়েছি।'

তিনি বলেন, 'তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এক বছর আগের অবস্থা এখন নেই। তবে আমরা হতাশ হচ্ছি বেশকিছু অ্যাকশনের কারণে।'

'আমাদের মধ্যকার অনৈক্য ও বিভাজনই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। আমি আশা করব এটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।'

অনুষ্ঠানে উপস্থিত মির্জা ফখরুলকে উদ্দেশ্য করে মতিউর রহমান বলেন, 'আমরা লক্ষ্য করেছি, বিএনপির আচরণ আগের থেকে অনেক পালটেছে। আশা করব, তারা যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে পরিস্থিতি এখন যে অবস্থায় আছে তেমনই থাকবে এবং আমাদের আবার গণমাধ্যম দিবসে সরকার ও দলের সমালোচনা করতে হবে না।'

'গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র হবে না—এটা পরিষ্কার। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে, আমাদের কথা বলতে দিতে হবে, লিখতে দিতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

মাহফুজ আনাম। ছবি: পলাশ খান/স্টার

'মামলা দিয়ে সাংবাদিক হেনস্তার তীব্র নিন্দা জানাই'

সবশেষে সভাপতির বক্তব্যে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, 'শেখ হাসিনার সরকার এত জনধিকৃত হয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকা। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অনেক আইনের ভুক্তভোগী হয়েছিলাম।'

তিনি বলেন, 'আরও উদ্বেগ প্রকাশ করছি যে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট কোনো অপরাধের মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা এর কিছু বেশি সাংবাদিকের নামে মামলা হয়েছে। অথচ, আজকে ২৬৬ জন সাংবাদিক খুন অথবা সহিংসতা-সংশ্লিষ্ট অপরাধের আসামি। এটা সাংবাদিকতা এবং আমাদের সবার জন্য অসম্মানের।'

তিনি আরও বলেন, কেউ কোনো দোষ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে সঠিকভাবে মামলা করে শাস্তি দেন। সেক্ষেত্রে আমরা আর তার পাশে দাঁড়াবো না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার ৬-৭ মাস পেরোলেও তদন্ত একদম এগোয়নি। সরকারকে ধন্যবাদ জানাই যে বেশিরভাগ সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়নি। কিন্তু তাদের তো মর্যাদাহানি হচ্ছে, দৈনন্দিন জীবনে এক ধরনের ভয়ের মধ্যে আছেন। তারা মব আক্রমণের ভয়ে থাকেন। এই মুহূর্তে অন্তত ১৩ জন সাংবাদিক জেলে আছেন।

মাহফুজ আনাম বলেন, 'মামলার যে প্রবণতা, ১০০ জনের নামে মামলা করে তার মধ্যে একটা সাংবাদিকের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের কিছু করার নেই, জনগণের অধিকার আছে মামলা করার। মেনে নিলাম। কিন্তু, আইনের অপপ্রয়োগ হলে, অপব্যবহার হলে সরকার কি কিছু করবে না?'

তিনি প্রস্তাবনা দেন, 'সরকার প্রয়োজনে এই ২৬৬ জন সাংবাদিকের নামে যেসব মামলা হয়েছে তার মধ্য থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১০-১৫টা মামলা বিশেষভাবে দেখুক। যদি সেখানে দেখতে পায় যে সাংবাদিকদের নামে মামলাটা মিথ্যা, তাহলে কেন কোনো পদক্ষেপ নেবে না? আমাদের কিছু করণীয় নেই—বারবার এটা বলার অর্থ হচ্ছে, যারা এসব মামলা দিয়ে সাংবাদিকদেরকে হেনস্তা করছে, তাদেরকে আরও বলিষ্ঠ করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।'

ছবি: পলাশ খান/স্টার

'সরকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াক' দাবি রেখে তিনি বলেন, 'সাংবাদিকদের নামে হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে যাতে তাদের জামিন পেতে অসুবিধা হয়। তার মানে সুপরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে। আমরা অনুরোধ করব, আইন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং অন্যান্য যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছেন, তারা যেন উদ্যোগী হয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।'

সাংবাদিকদের নামে এসব মামলার কারণে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সম্পাদক পরিষদ ফ্যাসিবাদী সময়ে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে কোনোভাবেই কোনোরকম আপস করিনি। যার ফলে আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিদ্বন্দ্বী করে আরেকটা প্রতিষ্ঠান ওই সময়কার সরকারের সাহায্যে স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেশপ্রেম, সমাজের উন্মেষ, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি এবং কোনো সময় সম্পাদক পরিষদের কোনো সদস্য এমন কোনো কাজ করবেন না, যেখানে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও দেশের স্বার্থ বিন্দুমাত্র আপস করা হবে।'

গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান, 'আপনারা এই মূল্যবোধটা রাখবেন, জনগণ কিন্তু আমাদের বিচার করে কী ধরনের নিউজ করছি, কী ধরনের এডিট করছি, কোথায় আমাদের অবস্থান সেটার ভিত্তিতে। পাঠক ও দর্শকই হচ্ছে আমাদের বিচারের মানদণ্ড। আমরা যেন পাঠকদের কোনো সময় হতাশ না করি।'

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, 'অনেক গণমাধ্যম বন্ধ হয়েছে, অনেক ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা হয়েছি। সেগুলো আর ভবিষ্যতে চাই না। যারা জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, আমরা আশা করব তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।'

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ, সমকাল সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিন প্রমুখ।

Comments