ক্ষমতা ছাড়ার পরামর্শে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘গুলি করে মেরে ফেলো আমাকে, গণভবনে কবর দিয়ে দাও’

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা
শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তেও সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিলে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা রেগে গিয়ে বলেন, 'তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।'

গত বছরের ৪ ও ৫ আগস্ট গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের গোপন বৈঠকের ঘটনা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে (ফরমাল চার্জ) তুলে ধরেছেন আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন।  

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় গত রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে এসব ঘটনা পড়ে শোনান।  

আনুষ্ঠানিক অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তেও জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকতে অনড় ছিলেন। তিনি সেনাপ্রধানকে শক্ত হয়ে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন। 

ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে ৪ আগস্টের রাত ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর। সেই রাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকে রাগারাগি ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

গণভবনের সেই বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের তৎকালীন আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং বিমান বাহিনীর সাবেক এক প্রধানও ছিলেন। রাত ১২টা থেকে সোয়া ১২টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে তৎকালীন প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রসঙ্গ তুললে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, 'যা হবার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।' 

শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দিলে তারেক সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, 'সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললেই বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে।' 

এসময় তারেক সিদ্দিকী বিমান বাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথা বলায় বিমান বাহিনী প্রধান ভীষণ রেগে যান এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডুবাবে।'

সেসময় অপরিচিত এক ব্যক্তি (যাকে ডিউটিরত এসএসএফ সদস্যরাও চেনেন না) গণভবনে প্রবেশ করলে শেখ হাসিনা সভা শেষ করে দেন। 

'গ্যাং অব ফোর' 

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের সেই সময়ে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তবে ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা এর বিরোধিতা করেন।

সেই রাতে 'গ্যাং অব ফোর' নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে নিয়ে যান। তারা শেখ হাসিনাকে বলেন, 'এখন কোনোভাবেই নরম হওয়া যাবে না, নতি স্বীকার করা যাবে যাবে না।'  

৪ আগস্ট বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিজিকে ফোন করে জানানো হয় ৫ আগস্ট সকালে বিটিভি সেন্টারে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারের কথা।

'অস্ত্র-গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই, ফোর্স টায়ার্ড হয়ে গেছে'

পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ৯টায় শেখ হাসিনা আবারও গণভবনে বৈঠক করেন। সেসময় পুলিশের আইজি এবং মন্ত্রীপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমানও গণভবনে ছিলেন। 
 
বৈঠকে শেখ হাসিনা পুলিশের আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে দেখিয়ে বলেন, 'ওরা ভালো কাজ করছে, সেনাবাহিনী পারবে না কেন?' 

এসময় পুলিশের আইজি বলেন, 'পরিস্থিতি যে পর্যায় গেছে তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এমন কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব না। আমাদের আর কিছু করার সামর্থ্য নেই। অস্ত্র-গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই, ফোর্স টায়ার্ড হয়ে গেছে।'

এরপর সামরিক কর্মকর্তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা রেগে গিয়ে বলেন, 'তাহলে তোমরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলো, গণভবনে কবর দিয়ে দাও।'

এরপর সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তাকে পদত্যাগে রাজি করাতে অনুরোধ করেন। 

সামরিক কর্মকর্তারা বলেন, 'সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে "লং মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচির কারণে গণভবন অভিমুখে ঢাকার চার পাশ থেকে মিছিল আসছে।'

'শেখ রেহানার কথায়ও পদত্যাগে রাজি ছিলেন না শেখ হাসিনা'

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এ পর্যায়ে শেখ রেহানা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। শেখ রেহানা একপর্যায়ে বড় বোন শেখ হাসিনার পা জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি হচ্ছিলেন না। পরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে কথা বলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা।

তাজুল ইসলাম বলেন, জয়কে বলা হয়, প্রাণে বাঁচাতে হলে তার মায়ের পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। টাইম একটি ফ্যাক্টর, এক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জয় পরিস্থিতি জানার পর তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। অবশেষে জয়ের কথায় ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। 

টেলিভিশনে প্রচারের জন্য শেখ হাসিনা তার একটি ভাষণ রের্কড করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সামরিক কর্মকর্তারা অপারগতা প্রকাশ করেন। এসময় তারা ব্যাগ গোছাতে ৪৫ মিনিট সময় বেধে দেন। 

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, কারণ গণভবন অভিমুখে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার যে মিছিল আসছে, তা সে সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে। এ স্রোত ছিল ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের অভাবনীয় গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্তরূপ। 

গণভবনে তখনও উপস্থিত ওবায়দুল কাদের ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। 

তাজুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট সকাল ১১টায় আইএসপিআর থেকে বিটিভির মহাপরিচালককে জানানো হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। 

চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, বঙ্গভবন সূত্রে জানা গেছে- ৪ আগস্ট শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে জানান দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে, তিনি যেন তৈরি থাকেন। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সেক্রেটারি রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারিকে ফোন করে জানান প্রধানমন্ত্রী যেকোনো সময় বঙ্গভবনে আসতে পারে। সেদিন বিকাল ৪টায় সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রচারের আগে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh alleges border abuse by BSF

Those pushed-in allege torture, abuses in India

A Bangladeshi woman has alleged that India’s Border Security Force (BSF) tied empty plastic bottles to her and her three daughters to keep them afloat, then pushed them into the Feni river along the Tripura border in the dark of night, in a chilling account of abuse at the border.

5h ago