গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন

২০২২ সাল থেকে র‌্যাবের গোপন সেলে ছিলেন সুব্রত বাইন

প্রধান উপদেষ্টার কাছে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। ছবি: পিআইডি

র‌্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশনের (টিএফআই) গোপন সেলে ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৬-৭ আগস্ট পর্যন্ত আটক ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন।

গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

আজ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে প্রতিবেদনের অংশবিশেষ প্রচার করা হয়।

ইন্টারপোলের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় থাকা সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও অপহরণসহ অনেক অপরাধের অভিযোগ আছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের ২৩ জন মোস্ট ওয়ান্টেডের একজন ছিলেন তিনি। নেপালে ধরা পড়ার পর ২০১২ সালে সেদেশের একটি কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যান এই সন্ত্রাসী।

কলকাতাসহ কয়েক জায়গায় একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও বারবার জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়েছেন সুব্রত।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে পরিচালিত একটি গোপন বন্দি বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সুব্রতকে আটক রেখেছিল র‍্যাব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'বাংলাদেশ ও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে পরিচালিত একটি গোপন ও বেআইনি বন্দি বিনিময় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২২ সালের এপ্রিলের শেষদিকে সুব্রত বাইনকে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার মাধ্যমে ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে একজন বাংলাদেশি নাগরিককে হস্তান্তর করে। হস্তান্তর হওয়া ব্যক্তি টিএফআই সেলে বন্দি ছিলেন।'

গুম কমিশন জানায়, তারা সুব্রতের বিনিময়ে ভারতে হস্তান্তর হওয়া সেই বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন।

তার ব্যাপারে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, 'আমরা জানতে পেরেছি, তিনি ভারতে পৌঁছানোর পর তার নামে একটি মামলা হয় এবং তিনি সেখানকার কারাগারে দণ্ড ভোগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি ভারতে তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার নথিগুলো দিয়েছেন আমাদের, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি যে ভারতে ছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়।'

কমিশনের মতে, সুব্রতর দাবি ২০২২ সালের ২৭ রমজান তাকে বাংলাদেশে আনা হয়। ভারতীয় মামলা-সংক্রান্ত নথির সঙ্গে এই তারিখ মিলে যাওয়ায় তার দাবিকে সত্য বলে ধরে নেয় কমিশন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'টিএফআই সেলে আটক থাকা অবস্থায় পাইলসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন সুব্রত। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না তার। এমনকি টিএফআই কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলতেন। আটক অবস্থায় প্রশিক্ষণ নেওয়ার যে গুজব অনলাইনে ছড়িয়েছে, তার কোনো ভিত্তি আমরা পাইনি।'

প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্তি পাওয়ার পর সুব্রত আবার তার সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে সক্রিয় করেন। শক্তিশালী রাজনৈতিক সংযোগ আছে এমন একজন বিত্তবান ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন হত্যার নির্দেশ দেওয়া শুরু করেন।

গত ২৭ মে কুষ্টিয়ায় এক সহযোগীসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন সুব্রত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এমন একজন অপরাধীকে (বেআইনিভাবে) আটক রাখার নির্দেশ শুধু র‌্যাব থেকে আসা অসম্ভব। র‌্যাবের সাংগঠনিক সংস্কৃতি থেকে আমরা ধারণা পাই, এমন সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশাসনের উচ্চপর্যায়—অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে।'

বন্দি থাকাকালে র‌্যাব কেন সুব্রতকে হত্যা করেনি, সেটিও বোঝার চেষ্টা করেছে কমিশন।

'র‌্যাব গোয়েন্দারা কেন সুব্রত বাইনকে এতদিন ধরে সম্পূর্ণ গোপনে, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই বন্দি রেখেছিল, তা স্পষ্ট না। এর চেয়ে অনেক কম অপরাধের জন্য বন্দিদের হত্যা করেছে তারা। তাকে হত্যা করারও পরিকল্পনা ছিল বলে জানতে পেরেছি আমরা। তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের ধারণা, একবার টিএফআই সেলে আটক হওয়ার পর সুব্রত আর তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিলেন না।'

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত থেকে অবৈধভাবে হস্তান্তরের কারণে আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ায় এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর বিচার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে কঠিন হয়ে পড়ে।

'এই মাত্রার গোপনীয়তা, বেআইনিভাবে বন্দি রাখা এবং অনানুষ্ঠানিক কৌশল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে যে শক্তিশালী করেনি, তা স্পষ্ট। বরং তা আরও দুর্বল করেছে। এটাই এই ঘটনার স্থায়ী শিক্ষা। জাতীয় নিরাপত্তার নামে গুমের পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, বাস্তবে সেই লক্ষ্য (জাতীয় নিরাপত্তা) প্রায়ই ব্যর্থ হয়,' প্রতিবেদনে বলা হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Election in first half of April 2026

In his address to the nation, CA says EC will later provide detailed roadmap

5h ago