মাইলস্টোন স্কুলে শোক, আতঙ্ক আর ক্ষোভ

ছবি: স্টার

মাঠে নেই স্কুল-কলেজের শিশুদের দৌড়াদৌড়ি, ক্লাসে নেই শিক্ষকদের পাঠদান, শিক্ষার্থীদের হইচই। আজ সকাল থেকে মাঠে হয়নি কোনো শরীর চর্চা, এমনকি বাজেনি কোনো ক্লাস শুরু ঘণ্টাও। অথচ একদিন আগেও রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ছিল শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মুখর।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের অনেকেই অভিভাবকদের নিয়ে প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। তাদের চোখে-মুখে ভয়, আতঙ্ক আর কষ্টের ছাপ। অনেকে চুপ করে ভবনটির দিকে তাকিয়ে আছে।

সকাল সোয়া ১০টার দিকে স্কুল মাঠে কথা হয় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিনের সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে স্কুল দেখতে এসেছে সে। জাহিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলে, 'আমার বন্ধু মাহীন মারা গেছে। যখন বিমানটা ক্রাশ করে তখন আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। বিমান কখনো এভাবে এসে আমার ক্লাসে পড়বে তা চিন্তাও করিনি। ওই ভবনে আমাদের বাংলা বিভাগের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ছিল। পাশে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম, টিচার্স রুম ছিল।'

জাহিন বলে, 'আমি মাঠে বসে ছিলাম। আম্মুর কাছ থেকে টিফিন খাওয়া শেষ করে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিলাম। দুয়েক পা এগোতেই দেখলাম বিমানটা আমার ক্লাসের ভেতরে ঢুকে গেল। ক্লাসে তখন ১১ জন ছিল। এমনি ক্লাসে প্রায় ৪০ জন থাকে। কোচিং ক্লাসে কম স্টুডেন্ট ছিল। আমার দুই বন্ধু বেঁচে ফিরেছে।'

জাহিনের মা নারগিস পারভীন বলেন, 'প্রতিদিন মূল ক্লাস শেষে কোচিং ক্লাস হয়৷ এই বিরতিতে গতকালও আমার ছেলে মাঠে খেতে আসে। ও হাত ধুয়ে ক্লাসে যাচ্ছিল। বিমানটা দেখে ছেলেকে বলি দেখো প্লেনে আগুন ধরে গেছে। এর এক মিনিটের মধ্যেই প্লেনটা ওদের ক্লাসে ক্রাশ করে। আমার ছেলেটা বেঁচে গেছে, ওই দুই মিনিটের জন্য খেতে বের হওয়ার কারণে। অনেকে বের হতে পারেনি, অনেকে আহত হয়েছে। এই কষ্ট সহ্য করার মতো না।'

এদিকে সকাল থেকেই মাইলস্টোন স্কুলে উৎসুক জনতার ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে৷ এই ভিড়ে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, উৎসুক জনতা ও স্থানীয়রা আছেন। তাদের অনেকে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাইলস্টোন স্কুল পরিদর্শনে আসেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করেই তিনি ঘটনাস্থলে যান। সেখান থেকে কলেজ ভবনের দিকে যাওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা আইন উপদেষ্টাকে ঘিরে ধরে। প্রশাসনের জবাবদিহি চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার পরে কলেজের ৫ নম্বর ভবনের নিচতলায় কনফারেন্স কক্ষে যান। তাদের সঙ্গে কলেজের শিক্ষকেরাও ছিলেন। সেখানে পাঁচ থেকে সাতজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধির সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। এ সময় বাইরে শত শত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।

মাঠে কথা হয় মাইলস্টোন কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে মো. রাতুল চোধুরীর সঙ্গে। ঘটনার সময় তিনি হোস্টেলে ছিলেন। রাতুল জানান, 'বড় আওয়াজ শুনে আমরা পাঁচ থেকে ছয়জন দৌড়ে আসি। এসে দেখি, আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে, আর মানুষরা ভিডিও করছে। গ্রিল ভেঙে দগ্ধ শিক্ষার্থীদের বের করা হচ্ছিল। এরপর সেনাবাহিনী আসে, সবাইকে বের করা হয়। একটা প্লেন এসে পড়বে কলেজে -এরকম হবে এটা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।'

রাতুলের আজ রসায়ন দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল। তবে সেই পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। রাতুল বলেন, 'গতকাল রাত তিনটার দিকে জানতে পারলাম, আজ পরীক্ষা হবে না। আমাদের বন্ধুদের অনেকে সকালে পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। অথচ আমাদের গভীর রাতে জানানো হলো আজ পরীক্ষা হবে না।'

এদিকে নিহত-আহতদের তথ্যের বিষয়ে হেল্প ডেস্ক চালু করা হয়েছে বলে জানান মাইলস্টোন কলেজের পরিচালক রাসেল তালুকদার। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক নম্বর ভবনের নিচে এই সংক্রান্ত হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। শিক্ষকেরা সেখানে তথ্য হালনাগাদ করছেন। অভিভাবকেরা সেখানে তথ্য দিচ্ছেন, নিচ্ছেন।'

রাসেল তালুকদার আরও বলেন, 'আমাদের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা শোকাহত, মর্মাহত।'

Comments