পর্যটনের জন্য খুলেছে সুন্দরবনের দুয়ার, যেভাবে যাবেন

ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

নদী আর বনের মিলন যেখানে, সেখানেই জন্ম নিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন—সুন্দরবন। তিন শতাধিক নদী, খাল ও খাড়ির আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এই বন দাঁড়িয়ে আছে, মানুষের ভিড় থেকে কিছুটা দূরে, অথচ কাছে টানে আপন মহিমায়। এখানে ঢুকলেই পৃথিবীর সব কোলাহল মিলিয়ে যায়—শুধু শোনা যায় প্রকৃতির নীরব সুর, পাখির ডাক, জোয়ার-ভাটার ছন্দ আর বাতাসে দুলে ওঠা গাছের ফিসফিসানি।

প্রকৃতিকে বিকশিত হওয়ার সময় দেওয়ার জন্য জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই সময় বনে প্রবেশের অনুমতি থাকে না বনজীবীদেরও। বনের প্রাণীরা যেন নিজের মতো করে বাঁচতে পারে, বংশ বিস্তার করতে পারে, তার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর এলেই আবার খুলে যায় বনের দরজা। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবহাওয়া আরামদায়ক থাকে।

যাত্রাপথের আমন্ত্রণ

সুন্দরবনের ভেতরে কোনো হোটেল নেই। এখানে থাকতে হয় লঞ্চ বা ট্রলারে। সেখানেই চলে রান্নাবান্না ও খাওয়া-দাওয়া। তাই একা একা বা চাইলেই সুন্দরবনে যাওয়া যায় না। এর জন্য ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হয়। তারাই বন বিভাগের অনুমতি থেকে শুরু করে গাইড, নিরাপত্তারক্ষী ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা করেন।

ছবি: হাবিবুর রহমান

সুন্দরবনে ট্যুর অপারেটরদের সংগঠনের নাম 'সুন্দরবন টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন'। খুলনা ও ঢাকায় তাদের অফিস আছে। গুগল করেও তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের খোঁজ পাওয়া যাবে। সংগঠটির অধীনে মোট ৬৫টি নৌযান আছে।

ঢাকা থেকে সুন্দরবনে যেতে চাইলে প্রথম গন্তব্য খুলনা, বাগেরহাটের মোংলা বা সাতক্ষীরার শ্যামনগর। সেখান থেকেই শুরু হয় আসল যাত্রা। তবে বেশ কিছু ট্যুর অপারেটরস ঢাকা থেকে নদী পথে পর্যটকদের সেবা দিচ্ছেন। ঢাকার সদরঘাট থেকে করপোরেট প্যাকেজে পর্যটকরা বিভিন্ন নদী ঘুরে সুন্দরবনে আসছেন।

তবে একদিনের জন্য সুন্দরবনে ভ্রমণ করতে চাইলে যেতে পারেন মোংলার অদূরে করমজল বা হাড়বাড়িয়া। খুলনা থেকে নদী বা সড়ক পথে কালাবগী কিংবা ট্রলারে করে শেখেরটেক এবং ঢাকা থেকে সরাসরি সাতক্ষীরা আর সেখান থেকে নৌযানে কলাগাছিয়া বা দোবেকীতে যাওয়া যায়। তবে হাড়বাড়িয়া, শেখেরটেক ও দোবেকীতে ঢুকতে হলে বন বিভাগের বিশেষ অনুমতি প্রয়োজন।

খরচ ও ভ্রমণব্যবস্থা

ট্রলারে করে করমজল, কালাবগী বা কলাগাছিয়া যেতে খরচ হবে ট্রলারপ্রতি ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। সেখানে ২০ থেকে ৩০ জন একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন। হাড়বাড়িয়া, শেখেরটেক ও দোবেকীর মতো কিছু জায়গায় যেতে খরচ পড়ে ৬ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।

তবে যারা গভীরভাবে সুন্দরবন উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য রয়েছে ট্যুর অপারেটরদের বিভিন্ন প্যাকেজ। এক্ষেত্রে পর্যটকরা সাধারণত তিন দিন দুই রাতের প্যাকেজ নেন। এতে ভ্রমণের অনুমতিপত্র থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, থাকা, নিরাপত্তা—সবকিছুর ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত জনপ্রতি খরচ পড়ে সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লঞ্চে বা ক্রুজ শিপে গেলে খরচ পড়ে সাড়ে ১৪ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে।

ছবি: হাবিবুর রহমান

আরও আছে কাঠের ট্রলারে ভ্রমণের সুযোগ। খুলনা বা সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে শুরু হওয়া এই ভ্রমণ আরও রোমাঞ্চকর। ১০–১৫ জনকে নিয়ে ছোট্ট ট্রলার ভেসে চলে বনের গভীরে। নিরাপত্তার জন্য থাকে বনরক্ষী ও গাইড। দুই রাত তিন দিনের এই ভ্রমণে ভ্রমণকারীরা নিজের ইচ্ছামতো বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে পারেন। জনপ্রতি খরচ প্রায় সাড়ে ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা।

কোথায় কোথায় ঘুরবেন

সুন্দরবনের প্রতিটি কোণেই আছে অপার বিস্ময়। তবে সব জায়গায় ভ্রমণ অনুমতি পাওয়া যায় না। ঘোরার মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হলো—

করমজল ও হাড়বাড়িয়া: মোংলার সবচেয়ে কাছের স্পট। করমজলে আছে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। হাড়বাড়িয়ায় কাঠের ট্রেইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় পদ্মপুকুর, ওয়াচ টাওয়ার থেকে বনভূমির অসাধারণ দৃশ্য।

কটকা ও কটকা সমুদ্র সৈকত: এখানে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় হরিণের দল। একটু দূরেই লাল কাঁকড়ায় ভরা সৈকত আর বঙ্গোপসাগরের বিশালতা। এখানে বনের ভেতর দেড়-দুই কিলোমিটার হেঁটে সমুদ্র পর্যন্ত যেতে হয়।

দুবলার চর: রাসমেলার জন্য প্রসিদ্ধ এই দ্বীপে প্রতি বছর হাজারো মানুষ আসেন পূণ্যস্নানের জন্য। এখানেই হাজারো জেলে সমুদ্র থেকে মাছ ধরে শুটকি তৈরি করেন। জেলেরা সেখানে বছরে ছয় মাস থাকতে পারেন। পর্যটকরা শুটকি পল্লী ঘুরে জেলেদের কাজকর্ম দেখতে পারেন।

হিরণ পয়েন্ট: এটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এখানে কাঠের রাস্তা ধরে এগোতে গেলে হরিণ, বানর, নানা পাখি চোখে পড়ে। ভাগ্যে থাকলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারও সামনে এসে দাঁড়াতে পারে।

ছবি: হাবিবুর রহমান

নিয়মকানুন ও পরিবেশ সচেতনতা

বনের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে বন বিভাগের অনুমতি আবশ্যক। অনুমতির জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যেতে হয়। ভ্রমণের অন্তত তিন দিন আগে আবেদন করতে হয়। এ কারণে অন্তত পাঁচ দিন আগে ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।

ড্রোন ওড়ানো, আগ্নেয়াস্ত্র বহন কিংবা বন্যপ্রাণীকে বিরক্ত করার মতো কাজ সুন্দরবনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বন বিভাগ এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকে।

২০২৩ সাল থেকে সুন্দরবনের ভেতর প্লাস্টিক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে বন বিভাগ। তাই প্লাস্টিক বোতল বা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সঙ্গে নেওয়া যাবে না। এর বদলে ব্যবহার করতে হবে ধাতু বা কাঁচের বোতল।

ভ্রমণের প্রস্তুতি

সুন্দরবনে ভ্রমণ মানেই অনেক দূরে লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। তাই সঙ্গে রাখতে হবে প্রয়োজনীয় ওষুধ, টর্চলাইট, মোবাইল চার্জার, শীতকালে ভারী পোশাক। অবশ্যই দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করতে হবে, সঙ্গে থাকবেন বন বিভাগের নিরাপত্তারক্ষী।

সুন্দরবনে মোবাইল নেটওয়ার্ক একেবারে নেই তা নয়, তবে সীমিত। বিভিন্ন অপারেটরের নেটওয়ার্ক বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। তুলনামূলকভাবে টেলিটকের নেটওয়ার্ক এখানে শক্তিশালী।

ভ্রমণের সময় মনে রাখতে হবে—সুন্দরবন শুধুই আমাদের ভ্রমণের স্থান নয়, এটি লাখো প্রাণীর আবাসস্থল। তাই বনের ভেতরে যতটা সম্ভব নীরব থাকতে হবে, কোনোভাবেই বর্জ্য বা প্লাস্টিক ফেলা যাবে না।

কেন যাবেন সুন্দরবনে

সুন্দরবনের নাম উচ্চারণ করলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক অচেনা নীরবতার ছবি। এখানে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রহস্য, হরিণের অবাধ বিচরণ, নদীতে ডলফিনের খেলা, অসংখ্য পাখির ডাক। এখানে গাছেরা দাঁড়িয়ে আছে শত বছর ধরে, মাটির নিচে শিকড় গেঁথে রেখেছে প্রকৃতির ভারসাম্য।

শহরের কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে যখন আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন সুন্দরবনের গহিনে, তখন বুঝবেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকার অনুভূতি কাকে বলে। এই অনুভূতি শুধু চোখে নয়, মনে রয়ে যাবে আজীবন।

দেশের সার্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে পর্যটকদের ভ্রমন। গত বছর পর্যটক মৌসুমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল। তারপরও ২ লাখ ৩০ হাজার পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছিলেন। এরমধ্যে ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে তিন দিনের প্যাকেজে ৫৯ হাজার পর্যটক গিয়েছিলেন। আর বাকিরা একদিনের প্যাকেজে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন।

Comments

The Daily Star  | English

Remittance rose 9% in August

However, August’s inflow was 2.22 percent lower than the previous month

2h ago