আজিজ-বেনজীরদের জন্যই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ: মির্জা ফখরুল

রোববার বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাজেট প্রতিক্রিয়া জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফাইল ফটো

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের মতো দুর্নীতিবাজদের জন্য সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। 

রোববার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাজেট প্রতিক্রিয়া জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে।

সেখানে বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'জনসাধারণের ম্যান্ডেট ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছে। যে সরকার নিজেই আইন-কানুন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ডামি সংসদ বানিয়েছে, এমন সরকারের পক্ষে বাজেট প্রদানের কোনো নৈতিক অধিকার নেই।'

তিনি বলেন, '২০২৪—২৫ অর্থবছরের জন্য এ সরকারের প্রস্তাবিত বাজেট দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষদের শোষণের লক্ষ্যে একটি সাজানো হাতিয়ার মাত্র। বর্তমান লুটেরা সরকারের এ বাজেট কেবল দেশের গুটিকয়েক অলিগার্কদের জন্য, যারা শুধু চুরিই করছে না, তারা ব্যবসা করছে, তারাই পলিসি প্রণয়ন করছে, আবার তারাই পুরো দেশ চালাচ্ছে। এই বাজেট কল্পনার এক ফানুস। এই বাজেট ফোকলা অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে।'

'বাজেট প্রণয়নের জন্য যে সম্পদ প্রয়োজন, সেটাই এ অলিগার্করা লুট করে নিয়েছে। ব্যাংকগুলো খালি। সরকারের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে অলিগার্করা ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে শূন্য করে দিয়েছে। এ অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। আমানতকারীরা ব্যাংকে তাদের নিজস্ব জমাকৃত অর্থের চেক ক্যাশ করতে পারছে না। যেকোনো সময় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে,' যোগ করেন তিনি।

'দেশের রিজার্ভের অবস্থা তলানিতে চলে গেছে' উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, 'তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার রিজার্ভে নেই। ডলারের অভাবে ব্যবসায় বাণিজ্যে অচলাবস্থা চলছে। দেনা বাড়তে বাড়তে এমন হয়েছে, সেই দেনা শোধ করতেই বাজেটের বড় একটা অংশ চলে যাচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নে যে অর্থ লাগবে সেটা সংকুলানের প্রস্তাব করা হয়েছে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে। এ বাজেট কর-নির্ভর, এ বাজেট ঋণ-নির্ভর, এ বাজেট লুটেরা-বান্ধব।'

'এ বাজেট দেশি-বিদেশি ঋণ ও সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া করের নির্লজ্জ ফিরিস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বাজেট একদিকে সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ধ্বংসপ্রায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যদিকে গণমানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর তামাশা মাত্র,' বলেন তিনি।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'প্রস্তাবিত বাজেট চুরি হালাল করার ধান্দাবাজির বাজেট। এই বাজেটে দেশের অর্থ নতুনভাবে লুটপাটের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে অনেক বেশি। ঋণ ও ঘাটতিভিত্তিক বড় বাজেট অতীতে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, আগামীতেও হবে না।'

'অনির্বাচিত সরকারের ওপর করদাতারা আস্থা রাখে না' মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'এ বছর আগের ১২ বিলিয়ন ডলারের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে। এই বাজেট শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটির মধ্যে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটিই ঘাটতি। অর্থাৎ বাজেটের এক তৃতীয়াশংই ঘাটতি যা মেটানোর প্রস্তাব করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ দেড় লাখ কোটি ও বৈদেশিক এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে। ঋণ দিয়ে ঋণ পরিশোধের ফন্দি। অর্থাৎ কৈ এর তেলে কৈ ভাজা আর কী!'

তিনি আরও বলেন, 'এই ঋণ নেওয়া হবে সোভারেইন গ্যারান্টির কভারে। কারণ কো—লেটারাল দেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ঋণ সংস্থা ফিচ রেটিংস সম্প্রতি বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদী ঋণমান আবারও অবনমন করেছে। এর আগে মুডিস ও এস অ্যান্ড পিও বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। এই দেউলিয়া সরকারের ওপর কার আস্থা হবে ঋণ দিতে?'

মির্জা ফখরুলের মতে, সরকার কঠিন শর্তের বিদেশি হার্ড লোনের দিকে আরও ঝুঁকে পড়বে। আটকে পড়বে আরও গভীর ঋণ-ফাঁদে, যার বোঝা পড়বে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর।

'বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির কোনো দিক-নির্দেশনা নেই' মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'ডলার সংকটের কথা বলে আমদানি সংকুচিত করায় ক্যাপিটাল মেশিনারিস এবং র মেটেরিয়ালস আমদানি প্রায় অবরূদ্ধ। যার ফলে শিল্প কারখানা বন্ধের পথে। তিন হাজারের বেশি শিল্প, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে ও যাচ্ছে । নতুন কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না, হাজার হাজার শ্রমিক গ্রামে চলে গেছে ও যাচ্ছে। এ বাজেটে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির কোন আশা নেই। বাজেটে চাকরি হারানো দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য কোনো পুনর্বাসন রোডম্যাপ নেই।'

বিএনপি মহাসচিব বলেন, 'এই বাজেট শুধু গণবিরোধী নয়, এ বাজেট বাংলাদেশ বিরোধী। পুরো বাজেটটিই করা হয়েছে মেগা-প্রকল্প ও মেগাচুরির জন্য, দুর্নীতি করার জন্য। অর্থনীতির এই ত্রিশঙ্কুল অবস্থায় উচিত ছিল অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্পসমূহ বা অর্থহীন, অনুৎপাদক দৃশ্যমান অবকাঠামোগুলো বন্ধ রাখা। সেই অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনকল্যাণমুখী খাতে ব্যবহার করা যেত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি আরও সম্প্রসারিত করা যেত। কিন্তু সেগুলো বন্ধ করলে তো দুর্নীতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে! তাই সেটা করা হয়নি।'

'সরকার কৃষককে সহায়তা না করে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লক্ষ কোটি টাকা ভতুর্কির অর্থ তুলে দিয়েছে বিদ্যুৎ সেক্টরের অলিগার্কদের হাতে, অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ না কিনেই। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট দাবি করে, অন্যদিকে ভারতীয় আদানি কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনে, যার মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'এই বাজেট কালো টাকাকে সাদা করার বাজেট। কালো টাকায় ঢালাও দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ব্যক্তি ও যেকোনো কোম্পানিকে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকারের কোনো সংস্থাই কালো টাকা সাদাকারীদের কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। অর্থাৎ দায়মুক্তি বা আইনি ছাড় দেওয়া হলো। এর ফলে সৎ ও বৈধ আয়ের করদাতাদের নিরুৎসাহিত এবং দুর্নীতিকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা হলো।'

'কালো টাকা সাদা করার বিপরীতে সৎ করদাতাদের সবোর্চ্চ ৩০ শতাংশ হারে কর দেওয়ার বিধান বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক। এই পদক্ষেপ সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। কথায় কথায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে "জিরো টলারেন্সের" বুলি যারা আওড়ায় তাদের পক্ষে রাজস্ব বৃদ্ধির খোঁড়া যুক্তিতে দুর্নীতির বৈধ লাইসেন্স প্রদান যে অনৈতিক ও সাংঘর্ষিক—তা জেনে শুনেই দুর্নীতিবাজ সরকার অবৈধ সম্পদ অর্জনকারীদের দুর্নীতির এই লাইসেন্স দিচ্ছে,' যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'সরকারের আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা আজিজ-বেনজীরদের মতো দুর্নীতিবাজদের কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ সৃষ্টির জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কিছু রাজস্ব আদায় হলেও, এতে সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হবে। এই বাজেট দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দখলদার আওয়ামী সরকার ও তাদের মাফিয়া গুরুদের মাঝে ভাগাভাগির এক সুনির্দিষ্ট ইজারাপত্র মাত্র। এটি স্পষ্ট যে বাজেটটি এমন কতিপয় ব্যক্তির মুনাফার জন্য প্রণীত হয়েছে যারা এই অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে সাহায্য করছে।'

'আজিজ—বেনজীরদের মতো শত শত দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পাচারকারী চিহ্নিত হলেও গত ১৫ বছরে তাদের অনেকের বিচার করা হয়নি। অর্থপাচার করে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে ক্ষমতাসীনদের সহায়তায় তারা নিরাপদে পালিয়ে যাচ্ছে। এই মাফিয়া সরকারের পক্ষে দুর্নীতিবাজদের ধরা সম্ভব না। কারণ এসব দুর্নীতিবাজদের সহায়তায় এ সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে,' যোগ করেন মির্জা ফখরুল। 

মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এখন বিলাসী পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে সবকিছুর দামেই আগুন লেগেছে। মানুষের কেনার ক্ষমতা নেই। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। অনেকের সঞ্চয়ও নেই। এ অবস্থায় মাছ, মাংস, ডিম অর্থাৎ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য কেনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।' 

'এ বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু কীভাবে এ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে তার কোনো নির্দেশনা নেই। আর কে না জানে, সরকারি আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট কিছু সিন্ডিকেটের কারণেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য গত বছরের তুলনায় কয়েক গুন বেড়েছে। সিন্ডিকেট কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, বাজেটে সে বিষয়ে কোনো আলোচনাই স্থান পায়নি,' যোগ করেন তিনি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে একজন ডামি সংসদ সদস্যের প্রতিবেশী দেশে নৃশংসভাবে খুন হওয়ার যে সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে সেখানে তার স্বর্ণ চোরাচালানসহ নানাবিধ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার কাহিনী উঠে এসেছে। এর নেপথ্যে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট আরও শক্তিশালী গডফাদারের কথাও বলা হচ্ছে। আনোয়ারুল আজিম আনার বর্তমান সরকারি দলের নমিনেশন পায় এবং কারা এ সরকার চালায় তা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।'

এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ। বিএনপির বাজেট প্রতিক্রিয়ার পুরো বক্তব্য নিচে দিয়ে দেওয়া হলো।

 

 

Comments

The Daily Star  | English
DHL Daily Star Bangladesh Business Awards 2023

DHL, Daily Star honour five business luminaries for outstanding achievements

The theme of this year's event is "Bangladesh on the rebound".

5h ago