কর্ণফুলী নদীর নামকরণের কিংবদন্তি
কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম শহর। নদীটিকে নগরীর 'লাইফলাইন' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে নদীটি বঙ্গোপসাগরে পড়ার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলা দিয়ে ২৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে।
এক সময় যখন চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না এবং যখন নদীর ওপর সেতু ছিল না, তখন কর্ণফুলী নদী নৌযানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
নদী দিয়ে যাতায়াতের জন্যও তখন মানুষ নৌকা ব্যবহার করত। এমনকি আজকের দিনেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণপরিবহণ ও পণ্য পরিবহণে এই নদীপথ ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৩১ সালে চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল সেতু নির্মাণ করা হয়, যা পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে রেল ও সড়ক সেতুতে রূপান্তরিত হয়। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের উপজেলাগুলোর পাশাপাশি বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
এরপর বন্দরনগরীর চাক্তাই এলাকায় এই নদীর ওপর ১৯৮৯ সালে একটি ও ২০১০ সালে একটি সড়ক সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হয়। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
কর্ণফুলী নদীর নামকরণ নিয়ে ২টি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এর একটি টমাস হারবার্ট লেউইনের 'অ্যা ফ্লাই অন দ্য হুইল' বইয়ে লেখা আছে। কথিত আছে, এই নদীর প্রাচীন নাম ছিল 'কাইঞ্চা খাল'। 'কাইঞ্চা খাল' কেন কর্ণফুলী নামে নামকরণ করা হয়েছিল, তা নিয়ে এ বইয়ে একটি গল্প বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, একবার কোনো এক পূর্ণিমা রাতে চট্টগ্রামের এক রাজকুমারী ও রাজকুমার দম্পতি কাইঞ্চা খালে নৌবিহারে জ্যোৎস্না রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন। ঢেউ খেলানো জলের উপরিভাগে চাঁদের প্রতিবিম্বের সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় রাজকুমারী নদীর ওপর কিছুটা ঝুঁকে পড়ে এবং ঠিক তখনই তার কানের ওপরে চুলে আটকানো ফুল হঠাৎ নদীতে পড়ে যায়। এই ফুলটি রাজকুমার তার চুলে গুঁজে দিয়েছিলেন। সেজন্য এটি তার কাছে মহামূল্যবান।
রাজকুমারী ফুলটি হারানোর পর শোকাহত হয়ে পড়েন। ফুলটি উদ্ধারের জন্য সে তৎক্ষণাৎ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ব্যর্থ হন। পরিবর্তে তীব্র স্রোতে তিনি নদীতে তলিয়ে যান। রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে রাজকুমারও নদীতে ঝাঁপ দেন। তিনিও তাকে উদ্ধারে ব্যর্থ হন।
শোকাহত রাজকুমার মৃত্যুর পরে রাজকুমারীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য নিজেকে নদীতে ডুবিয়ে দেন। এই ট্র্যাজেডির কারণে 'কর্ণফুল' শব্দ থেকে নদীর নাম 'কর্ণফুলী' হয়েছে। 'কর্ণফুল' অর্থ 'কানে শোভা পায় যে ফুল'।
আরেকটি কিংবদন্তি হলো—একদিন এক পাহাড়ি রাজকন্যা তার সহচরীদের সঙ্গে কাইঞ্চা খালে গোছল করতে গিয়েছিলেন। পানিতে ডুব দিয়ে গোছল শেষে তীরে উঠে দেখতে পান তার 'কর্ণফুল' হারিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তা খুঁজে পাওয়া যায় না। শোকাহত রাজকন্যা অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়। তখন থেকে 'কাইঞ্চা খাল' কর্ণফুলী নদী নামে পরিচিতি পায়।
প্রখ্যাত গায়ক, গীতিকার ও সঙ্গীতজ্ঞ মলয় ঘোষ দস্তিদার তার 'কর্ণফুলীর গান'-এ লিখেছেন—
ছোড ছোড ঢেউ তুলি (ছোট ছোট ঢেউ তুলে)
লুসাই পাহাড়ুত্তুন নামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী (লুসাই পাহাড় থেকে নেমে কর্ণফুলী প্রবাহিত হচ্ছে)।
পাহাড়ি কোন সুন্দরী মায়া (পাহাড়ের এক সুন্দরী মেয়ে),
সেয়ান গইত্তো যায় (নদীতে স্নান করতে গিয়েছিল)।
সেয়ান গরি উডি চায় যে (স্নান করে তীরে উঠার পর সে দেখলো)
কানোর ফুল তার নাই (যে ফুলটি তার কানে শোভা পাচ্ছিল, সেটি নেই)।
যেদিন কানোর ফুল হাজাইয়ে (যেদিন সে কানের ফুল হারালো),
হেই দিনত্তুন নাম কর্ণফুলী (সেদিন থেকে নদীর নাম কর্ণফুলী)।
লুসাই পাহাড়ুত্তুন নামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী (লুসাই পাহাড় থেকে নেমে কর্ণফুলী প্রবাহিত হচ্ছে)…'
তবে নদীর নামকরণ নিয়ে আরেকটি কিংবদন্তি আছে। অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে আরব বণিকেরা ইউরোপে রপ্তানির জন্য কামরূপ ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে 'করণফোল (লবঙ্গ)' নিয়ে আসত। একদা এক আরব বণিক এই নদী দিয়ে নৌযানে করে 'করণফোল' নিয়ে আসছিলেন। যাত্রাপথে নৌযানটি ডুবে যায়। নদীতে করণফোল বোঝাই নৌযান ডুবে যাওয়ায় তখন থেকে নদীটির নাম হয় 'কর্ণফুলী'।
প্রখ্যাত আরব কবি ইমরুল কায়েস প্রাচ্যের লবঙ্গ নিয়ে লিখেছেন,
'যেমন উপকূলের হাওয়া আসে ভেসে (Like the coast breeze comes laden),
লবঙ্গের সুবাসে (With fragrance of cloves)'
তথ্যসূত্র:
বন্দরশহর চট্টগ্রাম, আব্দুল হক চৌধুরী
চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত, তারকানাথ দাস
অরণ্য জনপদ, আবদুস সাত্তার
কর্ণফুলীর গান, মলয় ঘোষ দস্তিদার
কর্ণফুলী নদী, বাংলাপিডিয়া
Comments