লিথিয়ামের চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিতে চায় দক্ষিণ আমেরিকা

লিথিয়ামের চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিতে চায় দক্ষিণ আমেরিকা
চিলির একটি লিথিয়াম মাইন। ছবি: রয়টার্স

জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ দক্ষিণ আমেরিকা সফরে যান। উদ্দেশ্য ছিল লিথিয়ামের নতুন উৎস খুঁজে বের করা। 

দক্ষিণ আমেরিকায় গিয়ে চ্যান্সেলর শলৎজ আর্জেন্টিনা, চিলি ও ব্রাজিলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই ৩টি দেশকে বলা হয় 'লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গেল' যেখানে প্রচুর পরিমাণে লিথিয়াম রয়েছে। 

জার্মানিতে যে শুদ্ধ জ্বালানির (ক্লিন এনার্জি) বিপ্লব শুরু হয়েছে, সেটি সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এই লিথিয়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাতু। এটি বুঝতে পেরেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটির নেতার এই দক্ষিণ আমেরিকা সফর। 

এই তথাকথিত লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গেলের ওপর চীনেরও নজর রয়েছে। দেশটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দেশগুলোর সঙ্গে লিথিয়াম নিয়ে কিছু আগ্রাসী চুক্তি করেছে। চীন খুব ভালো করেই জানে নিজ দেশের উৎপাদন খাতে লিথিয়ামের বাড়তি চাহিদা মেটাতে এখনই এই ধাতুটির সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। 

ছবি: রয়টার্স

গত মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং 'সামিট অব দ্য কমিউনিটি অব লাতিন আমেরিকা অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান স্টেটস' এ ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের সঙ্গে চীনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর জোর দেন এবং শিল্পায়ন সহযোগিতা অক্ষুণ্ন রাখার অঙ্গীকার করেন। 

প্রেসিডেন্ট শি ও চ্যান্সলর শলৎজ যে আকাঙ্খা করছেন, সেটি হচ্ছে শত শত বছর ধরে ধনী দেশ ও করপোরেশনগুলো খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ গরীব দেশগুলোকে যেভাবে ব্যবহার করে আসছে, তার ধারাবাহিকতা। 

তবে বর্তমানে বিশ্বের শক্তিশালী দেশ ও করপোরেশনগুলোর নেতারা দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে নতুন ধরনের প্রতিরোধ দেখতে পাচ্ছেন। কারণ, এই অঞ্চলের নেতারা এখন তাদের দেশের লিথিয়ামের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক সচেতন। তাই এসব দেশের সরকারগুলো এখন অতীতের তুলনায় আরও কঠিনভাবে দরকষাকষি করছে। 

মাইনিং কোম্পানিগুলো নিয়ে চিলির বড় পরিকল্পনা

চিলি ভ্রমণের সময় জার্মান চ্যান্সেলর মাইনিং খাতে চিলি সরকারের অগ্রাধিকারগুলোর কথা উল্লেখ করেন। এই খাতের পরিবেশ এবং শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ও নীতিমালা আরও উন্নত করতে চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিচের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে শলৎজ বলেন, শ্রকিদের কাজের পারিবেশের দিক থেকে জার্মানির অবস্থান অনেক উঁচুতে। নতুন যেকোনো লিথিয়াম মাইনিং চুক্তির ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করতে চিলির সঙ্গে কাজ করতে পারে জার্মানি। 

উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা চিলির প্রেসিডেন্টেরও অন্যতম লক্ষ্য। ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশি-বিদেশি মাইনিং কোম্পানিগুলোর ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। 

এখন পর্যন্ত বামপন্থী প্রেসিডেন্ট বোরিচের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত হচ্ছে চিলির উত্তরাঞ্চলে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের 'ডমিঙ্গা প্রোজেক্ট' বাতিল করে দেওয়া। প্রস্তাবিত জায়গাটি একটি বণ্যপ্রাণী সমৃদ্ধ এলাকা। অর্থনৈতিক উদ্দীপনার চেয়ে পরিবেশগত গুরুত্বকে বেশি প্রাধান্য দেওয়ার অঙ্গীকার করেই ক্ষমতায় এসেছিলেন বোরিচ। 

নির্বাচনী প্রচারের সময় রোবিচ ঘোষণা করেছিলেন, ''আমরা এমন কোনো প্রকল্প চাই না যা, আমাদের লোকালয় ও দেশকে ধ্বংস করে দেবে। 
ডোমিঙ্গাকে 'না'।'

দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলো বিভিন্ন খনিজ সম্পদে ভরপুর এবং তারা আর আগের মতো এত সহজে সে সম্পদ হাতছাড়া করতে চায় না। ছবি: রয়টার্স

এটি ছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট সেবাস্টিয়ান পিনেরার অবস্থানের পুরো বিপরীত। ডমিঙ্গা প্রজেক্ট মূলত তারই মস্তিষ্কপ্রসূত এবং এই প্রকল্প বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে তিনি মাইনিং নীতিমালা শিথিলও করেছিলেন। 

পক্ষান্তরে প্রেসিডেন্ট বোরিচ শুধু নতুন মাইনিং নীতিমালার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান না। বিশ্বব্যাপী দিন দিন লিথিয়ামের বাড়তি চাহিদার সুফল নিতে তার লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় লিথিয়াম কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যেখানে বিদেশি কোম্পনিগুলো সংখ্যালঘু অংশীদার হতে পারবে। চিলিতে লিথিয়ামের যে বিশাল মজুদ আছে, তা থেকে পূর্ণ সুফল আদায় করতে চান তিনি। তার কাজে বিদেশিরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, সে বিষয়ে তাকে মোটেও চিন্তিত মনে হচ্ছে না। 

বলিভিয়াও ব্যাটারি তৈরি করতে চায়

চিলির পার্শ্ববর্তী দেশ বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টও সেদেশে লিথিয়ামের বিশাল মজুদ নিয়ে সজাগ। লিথিয়ামের বিশাল মজুদকে কীভাবে সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগানো যায়, সেজন্য প্রেসিডেন্ট লুইস আরসেরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে। 

চীনের অন্যতম বড় ব্যাটারি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান 'কনটেমপরারি অ্যামপেরেক্স টেকনোলজি'র সঙ্গে জানুয়ারি মাসে ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির পর বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, 'এই মূল্যবান খনিজ দীর্ঘদিন সুপ্ত অবস্থায় ছিল। আজ থেকে বলিভিয়ান লিথিয়ামের শিল্পায়নের নতুন যুগ শুরু হলো'। চীনের এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বলিভিয়া যৌথভাবে ব্যাটারি উৎপাদন করবে। 

বলিভিয়ার জন্য এটি ছিল একটি বিশেষ চুক্তি। এই প্রথম দেশটি এমন একটি চুক্তি করলো যার সব ক্ষেত্রেই তাদের অংশগ্রহণ থাকবে- খনি থেকে লিথিয়াম উত্তোলন এবং সেই লিথিয়ামের সাহায্যে ব্যাটারি উৎপাদন। ঐতিহাসিকভাবে কাঁচামাল থেকে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিক সুবিধার পুরোটা ভোগ করতে পারে না অনেক দেশ। 

বলিভিয়া বিশ্বের অন্যতম লিথিয়াম সমৃদ্ধ দেশ। ধারণা করা হয় বিশ্বে যত লিথিয়াম মজুদ আছে (এখন পর্যন্ত জানামতে ৩৯ মিলিয়ন টন) তার ৪ ভাগের একভাগই এই দেশটিতে। অথচ তারপরও বলিভিয়া সবদিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে গরিব দেশ এবং দেশটিতে অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। 

লিথিয়াম প্রক্রিয়াজাতকরণের দিক থেকে বলিভিয়ার সক্ষমতা এখনো অনেক কম। ২০২১ সালে দেশটি প্রায় ৫৪৩ টন লিথিয়াম উৎপাদন করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় লিথিয়াম রপ্তানিকারক দেশ অষ্ট্রেলিয়া একই সময়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন লিথিয়াম উৎপাদন করেছে। 

স্মার্টফোনের ব্যাটারি, কম্পিউটার, দ্রুত বাড়তে থাকা বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা ও উৎপাদনের কথা মাথায় রেখে দক্ষিণ আমেরিকার লিথিয়াম সমৃদ্ধ দেশগুলো এখন এমনভাবে নীতিমালা তৈরি করছে, যাতে তাদের দেশ এই খনিজ সম্পদের সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে পারে। 

এ জন্যই প্রেসিডেন্ট আরসে এখন বলিভিয়ার লিথিয়ামের পুরো উৎপাদন এবং সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পুরো প্রক্রিয়ায় আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। অর্থমন্ত্রী থাকার সময় তিনি এই লক্ষ্যেই বলিভিয়ার হাইড্রো-কার্বন শিল্পকে জাতীয়করণ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। 

Comments

The Daily Star  | English

Tribute to July uprising: Drone show lights up Dhaka's sky

In 12 vivid motifs, the July uprising came alive, tracing the heroism of Abu Sayed and the stirring role of women in the movement

12h ago