যে দেশে পরীক্ষা পাসের জন্য লাগাতে হয় ১০টি গাছ

এলিমেন্টারি স্কুল বা শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০টি করে গাছ লাগাতে হয়। 
যে দেশে পরীক্ষা পাশের জন্য লাগাতে হয় ১০টি গাছ
ছবি: ফিলিপিন ডেইলি ইনকোয়ার

'প্রচণ্ড দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত' – সংবাদপত্র খুললেই এমন শিরোনাম দেখতে পাওয়া এখন খুব স্বাভাবিক। তবে জনজীবনের এই শব্দগত বিপর্যস্ততা যে বাস্তবে কতটুকু বিস্তৃত, তার মাত্রা এবং কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে আমাদের ফিরতে হয় সেই প্রকৃতির কাছেই। চারপাশ ঘিরে এত অট্টালিকা, কল-কারখানা আর গাড়ির কালো ধোঁয়ায় যখন শ্বাস থমকে যায়, তখন ব্যথিত কবির মতোই বলতে ইচ্ছে করে, 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর'। 

তবে এতকালের গড়ে তোলা সভ্যতা, সংস্কৃতি আর অধুনা জীবনযাপন তো আর চাইলেই ফেলে দেওয়া যায় না। তবে একটি কাজ নিশ্চয়ই করা যায়, অরণ্যের ছোঁয়াকে শহুরে ফ্রেমে আনতে। যে যার জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব গাছ লাগাতে পারি। এমন কথা মাথায় রেখেই ফিলিপাইনের কংগ্রেসে আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষণ একটি নিয়ম করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ মে।

আইনিভাবেই এই দ্বীপরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক বৃক্ষরোপণের কর্মসূচিতে যুক্ত থাকতে হবে। এলিমেন্টারি স্কুল বা শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপেই তাদের জীবনে সবুজায়নের ইতিবাচকতা নিয়ে সচেতন করে তোলার জন্যই মূলত এ সিদ্ধান্ত নেওয়া।


 
মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের শিক্ষার্থীদের জন্যও একই নিয়ম। 'গ্রাজুয়েশন লিগ্যাসি ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যাক্ট' বিল পাস হবার পর এর অনুকূলে থাকা ব্যক্তিরা এই আইনটিকে জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলায় তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণের একটি স্বর্ণালী সুযোগ হিসেবে দেখছেন। এই আইনের ফলে এলিমেন্টারি স্কুল বা শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০টি করে গাছ লাগাতে হয়। 

ফিলিপাইনে প্রায় ৮ হাজার দ্বীপ রয়েছে এবং এই দ্বীপগুলোর চরাচরে বৃক্ষনিধন এতটাই বেড়ে যায় যে, এখন গাছ খুব একটা নেই। এর ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সামগ্রিক উন্নয়ন এবং কৃষিব্যবস্থাও অনেক হোঁচট খাচ্ছে শুধু এই গাছ কমে যাওয়ার ফলে। তারই জের ধরে একটি সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে এই পদক্ষেপ নিচ্ছে ফিলিপাইন সরকার। এ অভিযানের ফলে এ অঞ্চলের জলবায়ু ও মাটির উপযোগী, এমন সব গাছই শুধু রোপন করা হবে। এবং অভিযান চলাকালে সবদিক থেকেই সাহায্য করবে সরকার। এ আইন অনুযায়ী, এই গাছগুলো হয় বনে, ম্যানগ্রোভ এলাকায়, শহুরে অঞ্চল বা পরিত্যক্ত অঞ্চলে রোপণ করতে হবে। 

পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং সে জন্য 'আন্তঃপ্রজন্ম দায়িত্ব', এই ধারণাটির প্রচার ঘটাতে ফিলিপাইনের কংগ্রেস সদস্য গ্যারি আলেহানো এই বিলটি উত্থাপন করেন। 

বিলের নোটে ব্যাখ্যা অংশে তিনি লিখেছেন, 'আমরা যখন তরুণ প্রজন্মের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুস্থ বাস্তুতন্ত্রের অধিকার আছে বলে স্বীকার করছি, তাহলে বাস্তবে এই প্রক্রিয়াতে তাদের অবদান রাখতে না বলার কোনো কারণ নেই।' 

তার এই ভাবনাটি যে একেবারেই ফেলনা নয়, তা বেশ স্পষ্ট। কেন না প্রতিটি শিক্ষার্থী মাথাপিছু ১০টি করে গাছ লাগালে মোট গাছের সংখ্যা হবে এক বছরে ১৭৫ মিলিয়ন তথা ১৭ কোটি ৫ লাখ। বিস্তৃতভাবে গাছ লাগানোর অন্যতম সহজ উপায় হিসেবে আসলেই স্কুলের কাজ হিসেবে শিক্ষার্থীদের দিয়ে বৃক্ষরোপণ করানোর তুলনা হয় না। এই উদ্যোগের ফলে প্রতিবছর শুধু  বড় সমস্যার সহজ সমাধান হিসেবে আলেহানোর এই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত শুধু ফিলিপাইন নয়, ক্রমশ পরিবেশ সংকটে জড়িয়ে পড়া বিশ্ববাসীর জন্যই একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

স্কুলজীবনে শুধু বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা মুখস্থ করিয়ে বা পরীক্ষার খাতায় লিখিয়ে নিয়ে নয় বরং হাতে-কলমে একেকটি বৃক্ষের জন্মলগ্নের সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার তরুণ প্রজন্মের। যার উক্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল, তারই লেখনীর সুধা দিয়ে ইতি টানা যাক– করা যাক বৃক্ষের একটুখানি বন্দনা, 

"অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ ;
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ- ' পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।'

আমাদের আশপাশ যাতে মরুস্থলের নিষ্ঠুরতায় গ্রাস না করে ফেলে জীবন ও যাপনের নিয়মিত চর্চা, সেজন্য নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতনতাই হতে পারে প্রাথমিক হাতিয়ার। ফিলিপাইনের সময়োপযোগী ও অত্যাবশ্যকীয় এই পদক্ষেপটি অনুসরণ করে দেশে দেশে, শহরে শহরে আরো ভিন্ন রূপেও শুরু করা যায় সবুজ ছড়িয়ে দেয়ার প্রকল্প– প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যা মিলেমিশে একাকার হবে একদিন, প্রকৃতিরই বুকে। যে প্রকৃতি আমাদের শুরু ও শেষ, তাকে ধরে রাখার দায়টাও যে আমাদেরই। 

তথ্যসূত্র: ফোর্বস, উইফোরাম ও দ্য ওয়েদার নেটওয়ার্ক
 

Comments

The Daily Star  | English

Age limit for govt job entry: Panel suggests 35yrs for men, 37 for women

A government committee has recommended raising the maximum age limit for applying for public service jobs to 35 years for male candidates and 37 years for female applicants..The five-member committee, formed to review the feasibility of extending the age limit for applying for government j

3h ago