ম্যালেরিয়াবাহী মশার প্রজাতি নিশ্চিহ্ন করার কৌশল উদ্ভাবন

জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন বুরকিনা ফাসোর বিজ্ঞানী আবদৌলায়ে দিয়াবাতে। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর বিজ্ঞানী আবদৌলায়ে দিয়াবাতে এমন এক কৌশল উদ্ভাবন করছেন, যার মাধ্যমে জিন পরিবর্তন করে ম্যালেরিয়া সংক্রমণকারী মশার প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব।

আক্রান্ত স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া ছড়ায়। পুরুষ মশা কামড়ায় না, তাই সেগুলো ম্যালেরিয়া ছড়াতে পারে না। 

সিএনএনের প্রতিবেদন অনুসারে, 'জিন ড্রাইভ' নামে এই পদ্ধতির মাধ্যমে জিন এডিটিং করে পরিবেশে বন্ধ্যা পুরুষ মশা ছেড়ে দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে রোগ-বাহক স্ত্রী মশা আর সন্তান ধারণ করতে পারে না। দিয়াবাতে বলেন, 'এভাবে স্ত্রী মশার সংখ্যা কমে যায় এবং ম্যালেরিয়া সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণে আসে।'

অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী দিয়াবাতের এই গবেষণার জন্য তাকে ২০২৩ সালে 'ফলিং ওয়ালস প্রাইজ ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ম্যানেজমেন্ট' পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তার কাজটি ম্যালেরিয়ার জেনেটিক সমাধানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কয়েকটি কাজের একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে ম্যালেরিয়ার কারণে দিয়াবাতের জীবন হুমকির মুখে পড়েছিল। মশাবাহিত রোগটি থেকে দিয়াবাতে অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও রক্ষা পায়নি তার তিন-চার বছর বয়সী চাচাতো ভাইয়েরা। বর্তমানে দিয়াবাতে বুরকিনা ফাসোর স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব এবং পরজীবীবিদ্যা মেডিকেলের প্রধান। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, ম্যালেরিয়া বুরকিনা ফাসোতে মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। যেখানে দেশটির ২ কোটি ২০ লাখ বাসিন্দার প্রায় সকলেই, বিশেষ করে শিশুরা এই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। আফ্রিকায় ডব্লিউএইচও'র আঞ্চলিক অফিসের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে ম্যালেরিয়ার কারণে বুরকিনা ফাসোতে প্রায় ১৯ হাজার লোক মারা যায়। 

ডব্লিউএইচও'র সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ম্যালেরিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৬ লাখ ১৯ হাজার মানুষ মারা যায়। যেখানে এই মৃত্যুর প্রায় ৯৬ শতাংশই ঘটেছে আফ্রিকায় এবং মৃতের ৮০ শতাংশ ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।

বহু বছর ধরে কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহার ম্যালেরিয়া আক্রান্ত দেশগুলোতে সংক্রমণ এবং মৃত্যু কমাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু ডব্লিউএইচও'র তথ্যানুসারে, ২০১৫ সাল থেকে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়তে শুরু করে। এর কারণ হিসেবে তারা ক্রমবর্ধমান ব্যয় বৃদ্ধি, ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি এবং ভেক্টর মশার কীটনাশকের প্রতি প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশের কথা উল্লেখ করে।

দিয়াবাতে সিএনএনকে বলেন, 'ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম উদ্ভাবনই এই রোগকে জয় করার একমাত্র উপায়।'

তিনি বলেন, 'যদিও মশারি চমৎকার কাজ করছে… তবে এখন বিভিন্ন প্রজাতির মশার মধ্যে ব্যাপক কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, বিশেষ করে যেগুলো ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এসব প্রচলিত সরঞ্জামের সাহায্যে ম্যালেরিয়াকে পরাস্ত করা কঠিন। এ কারণে নতুন সরঞ্জাম উদ্ভাবন এবং পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বিদ্যমান সরঞ্জামগুলোর পরিপূরক হতে পারে। (অন্যথায়) আমরা কোনোভাবেই ম্যালেরিয়াকে পরাজিত করতে পারব না।'

দিয়াবাতে আশাবাদী যে, ম্যালেরিয়ার জন্য তার ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম 'জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি' যখন উন্মোচন করা হবে, তখন এটি হবে একটি 'গেম-চেঞ্জার'। 

তিনি বলেন, 'জিন ড্রাইভ আরও টেকসই এবং বাজেট-বান্ধব ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। এখানে জিনগতভাবে পরিবর্তিত মশাই আপনার জন্য কাজ করে। যেখানে অন্য (ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ) পদ্ধতিতে মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দৌড়াতে হয়।'

দিয়াবাতে আরও বলেন, 'এটি খরচ সাশ্রয়ী এবং টেকসই হওয়ার পাশাপাশি আফ্রিকার দুর্গম এবং প্রবেশ করা কঠিন এমন অঞ্চলগুলোতেও সহজে স্থাপন করা যাবে। তবে আফ্রিকাতে জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি চালু করতে আরও কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।' 

২০১৯ সালে দিয়াবাতের ভেক্টর কন্ট্রোল রিসার্চ অ্যালায়েন্স 'টার্গেট ম্যালেরিয়া' বুরকিনা ফাসোর পশ্চিমের বানা নামে একটি গ্রামে আফ্রিকার প্রথম জিনগতভাবে সম্পাদিত মশা ছেড়ে প্রকল্পটির প্রথম ধাপ পরিচালনা করে। 

টার্গেট ম্যালেরিয়ার তথ্যানুসারে, একই দিনে ১৪ হাজারেরও বেশি বন্ধ্যা পুরুষ মশাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছেড়ে দেওয়ার ২০ দিন পর আবার ৫২৭টি মশাকে পুনরায় ধরা হয়। 

সংস্থাটি জানায়, যদিও কাজটি প্রথমে ম্যালেরিয়া সংক্রমণকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে করা হয়নি। মূলত তথ্য সংগ্রহ, জ্ঞান তৈরি এবং স্থানীয় দক্ষতা বিকাশের জন্য করা হয়েছিল। তবে এই বিশ্লেষণ এবং সংগৃহীত ডেটা অমূল্য কিছু জ্ঞান প্রদান করেছে। যা আমরা ইতোমধ্যে আমাদের গবেষণার পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবহার করছি। 

তবে মশার ডিএনএ লক্ষ্য করে এরকম গবেষণা নতুন নয়। ২০১৩ সালে অক্সিটেক নামে মার্কিন এক বায়োটেক কোম্পানি এক ধরনের জিন-সংশোধিত মশা তৈরি করে। যেগুলো পীতজ্বর, ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাস ধারণকারী এডিস ইজিপ্টি মশার নারী প্রজাতিতে একটি মারাত্মক জিন প্রেরণ করে। এর ফলে জিন-পরিবর্তিত স্ত্রী মশার বংশধর লার্ভা পর্যায়ে মারা যায়।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে পুরুষ মশাকে বন্ধ্যা করার জন্য একটি এক্স-রেচালিত কৌশল চালু করে। যার লক্ষ্য ছিল জিকা সংক্রমণকারী স্ত্রী মশার প্রজনন হ্রাস করা।

তবে দিয়াবাতের গবেষণাটি পুরুষ মশাকে লক্ষ্য করে জিন সম্পাদনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথম। 

যদিও এ বিষয়ে বেশকিছু পরিবেশগত উদ্বেগ উঠেছে। বুরকিনা ফাসোর বাইরের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষগুলো দিয়াবাতের জিন ড্রাইভ প্রযুক্তিকে স্বাগত জানালেও গবেষণাটি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশের পর পরিবেশের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।

মালাউইয়ের ন্যাশনাল ম্যালেরিয়া কন্ট্রোল প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার লুম্বানি মুনথালি বলেন, 'যদিও জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি একটি ভালো উদ্ভাবন, যা সঠিক সময়ে আসছে। তবে এর পরিবেশগত প্রভাব এখনো অজানা।'

তিনি বলেন, 'জিন ড্রাইভ প্রযুক্তির জন্য জেনেটিক উপাদানগুলো পরিবর্তন করতে হবে। তাই আপনি কখনই জানেন না যে, আপনি যে নতুন ভেক্টর পাবেন সেটি পরিবেশ বা বাস্তুবিদ্যায় কী প্রভাব ফেলবে।' 

জার্মান-ভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ সেভ আওয়ার সিডস (এসওএস) জিন ড্রাইভ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে জোরালো প্রচারণা চালিয়েছে। তারা বলেছে, 'বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। মশা প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী, এমনকি মানুষের জন্য বিপজ্জনক বা ক্ষতিকারক বলে মনে হলেও সেটি তার আবাসস্থলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রজাতি নির্মূল বা এমনকি তাদের ওপর কারসাজির ফল সমগ্র বাস্তুতন্ত্রের ওপর পড়তে পারে।'

অ্যাডভোকেসি গ্রুপটি অবশ্য এর কারণ ব্যাখ্যা করে জানিয়েছে যে, পাখি ও ড্রাগনফ্লাইয়ের মতো অনেক প্রাণীর খাদ্যের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মশা। তারা উদাহরণ হিসেবে দক্ষিণ ফ্রান্সের ক্যামার্গের একটি প্রকৃতি সংরক্ষণাগারে জৈবিক কীটনাশক দিয়ে মশা ধ্বংসের পরীক্ষাটির কথা উল্লেখ করে। যেখানে মশা ধ্বংসের ফলে পাখি ও ড্রাগনফ্লাইয়ের সংখ্যা কমে গিয়েছিল।

তবে দিয়াবাতে বলেন, 'জিন ড্রাইভ প্রযুক্তি সম্পর্কে নির্দিষ্ট উদ্বেগগুলো প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সময় আমলে নেওয়া হবে।' 

তথ্যসূত্র: সিএনএন

গ্রন্থনা: আহমেদ বিন কাদের অনি

Comments

The Daily Star  | English
health sector reform in Bangladesh

Health sector reform: 33 proposals set for implementation

The Health Ministry has selected 33 recommendations from the Health Sector Reform Commission as it seeks to begin implementing the much-needed reform process in the country’s health system.

14h ago