'সিঙ্গাপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরো বিশ্বের জন্যই অশনি সংকেত'

সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর জানিয়েছে, দেশটিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘জরুরি’ অবস্থায় পৌঁছেছে।
সিঙ্গাপুরে ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশা নিধন
সিঙ্গাপুরে ফগার মেশিনের মাধ্যমে মশা নিধন। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সিঙ্গাপুর জানিয়েছে, দেশটিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি 'জরুরি' অবস্থায় পৌঁছেছে।

গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছর সিঙ্গাপুরে অন্যান্য বছরের তুলনায় কয়েক মাস আগেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

'সিঙ্গাপুর'স ডেঙ্গু "ইমার্জেন্সি" ইজ অ্যা ক্লাইমেট চেঞ্জ ওমেন ফর দ্য ওয়ার্ল্ড' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে সাধারণত জুনের শুরুতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুঙ্গে ওঠে। গত বছর দেশটির মোট ৫ হাজার ২৫৮ জন নাগরিক এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে চলতি বছরে জুনের আগেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল সিঙ্গাপুর নয়, সারা বিশ্বের জন্যই একটি অশনি সংকেত। বিশেষ করে উষ্ণ জলবায়ুর যে দেশগুলোতে ডেঙ্গুর ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা খুব সহজেই প্রজনন ও বংশ বিস্তার করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ডেঙ্গুর প্রকোপ সামনের বছরগুলোতে আরও বাড়বে এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।

ডেঙ্গু হলে সাধারণ সর্দি-জ্বরের মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যেমন উচ্চ মাত্রার জ্বর, মাথা ও শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রক্তপাত, শ্বাস প্রশ্বাসের জটিলতা, শরীরের কোনো অঙ্গ অকার্যকর হয়ে যাওয়া, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেসমন্ড ট্যান বলেন, 'আক্রান্তের সংখ্যা নিঃসন্দেহে বাড়ছে। আমরা জরুরি অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।'

বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পেছনে এখানকার চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দায়ী। সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে দীর্ঘ সময় ধরে গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে এবং সময়ে সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি হওয়ার কারণে তৈরি হওয়া অনুকূল পরিবেশে মশা এবং ভাইরাস উভয়ই ছড়িয়ে পড়ছে।

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত বৈশ্বিক ডেঙ্গু প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এখন মানুষ এ রোগে নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৫০ বছরে সারাবিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ গুণ বেড়েছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, 'কেবল (ডেঙ্গু) সংক্রমণের হারই বাড়ছে না, নতুন নতুন জায়গায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও তা মহামারির আকার ধারণ করেছে।'

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে রেকর্ড ৫২ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপে হাজারো মানুষের মৃত্যু হয় সে বছর। এই রোগে ফিলিপাইনে হাজারো মানুষের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে ডেঙ্গুকে জাতীয় মহামারি হিসেবে অভিহিত করা হয়।

২০১৯ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। সে বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে মাত্র ৩২৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল ছিল। পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপে অনেকে সঠিক চিকিৎসা পেতে সমস্যায় পড়েন।

একই বছরে, আফগানিস্তানে প্রথমবারের মত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। 

২০২০ সালে সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩৫ হাজার ৩১৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ২৮ জন মারা যান।

এ বছর এ পর্যন্ত মাত্র ১ জনের মৃত্যু হলেও সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় দেশটির কর্তৃপক্ষ সতর্কাবস্থা বজায় রাখছে।

সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, '২০২২ এর ২৮ মে পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৭০ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।'

মুখপাত্র আরও জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তবে এখনও তা গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে রয়েছে।

তবে প্রথাগত ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই এত মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় মেডিকেল বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, চলতি বছর দেশটিতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ক্ল্যারেন্স ইও জি কিন বলেন, 'ডেঙ্গু একটি মৌসুমি রোগ। যখন আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করে ও গরম বাড়তে থাকে, তখনই বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন।'

মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও জানান, বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতাল বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।

'তবে কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে, যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে।'– যোগ করেন তিনি।

রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ

উদীয়মান সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো রুকলানথি দে আলউইস জানান, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পেছনে গরম, আর্দ্র আবহাওয়া ও ভাইরাসের একটি শক্তিশালী নতুন ধরনই মূলত দায়ী।

তার আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

তিনি বলেন, 'আগের প্রেডিকটিভ মডেলিং গবেষণা থেকে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বে, যার কারণে আরও বেশি পরিমাণ ভূখণ্ড মশার প্রজনন উপযোগী হয়ে ওঠবে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়বে ডেঙ্গুর বিস্তার।'

এদিকে সিঙ্গাপুরের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশটিতে উষ্ণতার পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে বাড়ছে।

আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, বিদ্যমান হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ দেশটির দৈনিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে পারে।

চলতি বছরের মে মাসে সিঙ্গাপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ৩৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে।

জলবায়ু বিজ্ঞানী উইনস্টন চাউ বলেন, 'চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া মশার প্রজননের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে। এ কারণেই আমরা ডেঙ্গুকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারব না।'

মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন প্রতি বছর সিঙ্গাপুরে লাখো ডলার খরচ করা হয়। সরকারি উদ্যোগের মধ্যে আছে দেশজুড়ে ফগিং মেশিনের ব্যবহার ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণা। এমনকি গবেষণাগারে বিশেষ ধরনের মশার প্রজনন ঘটানোর মত অভিনব কার্যক্রমও  পরিচালিত হয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে।

বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি

গতকাল ৭ জুন সকাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর (ডিজিএইচএস) জানিয়েছে, নতুন রোগীদের মধ্যে ১৬ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। অন্যজন ঢাকার বাইরের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন।

স্টার ফাইল ছবি

এই মুহূর্তে ৭৫ জন রোগী ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে ৭০ জনই ঢাকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪৬৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৮৮ জন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠেছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কেউ মারা যাননি।

গত বছর দেশে ২৮ হাজার ৪২৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। যার মধ্যে প্রথম ৫ মাসে রোগী ছিল মাত্র ১০০ জন। ২০১৯ ও ২০২১ সালের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি বছর রোগীর সংখ্যা বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, এবছর মৌসুমপূর্ব জরিপে প্লাস্টিক ড্রামে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে জলমগ্ন ফ্লোরে লার্ভা ছিল ২০ শতাংশ। এ বছর তা ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

মশাবাহিত রোগ সহজে দূর হচ্ছে না

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির অবনতির কারণে সারাবিশ্বে উষ্ণতার পরিমাণ বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রোগগুলো থেকে খুব সহজে মুক্তির উপায় নেই।

এক্ষেত্রে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনতে ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিদ্যমান হার বজায় থাকলে মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সেক্ষেত্রে ডেঙ্গুর প্রকোপও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।

বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৪ ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ফলে একই ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় ৪ বার এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু বা তীব্র আকারের ডেঙ্গুর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তীব্র আকারের ডেঙ্গুর কারণে মৃত্যুর আশঙ্কা ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা যায়।

Comments