একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে দেখান

ড. বিজন কুমার শীল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষক। করোনাভাইরাস মহামারির সময় তিনি গণবিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তখন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে তিনি অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট নিয়ে গবেষণা করেন। এই কিট উদ্ভাবনে সফল হয়ে আলোচনায় আসেন। পরে নানা জটিলতায় সেই কিট আর বাজারে আসেনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চলে গেলেন। বিদেশে অবস্থান করছি। খবরটা পেলাম তার মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক পরে। ওই সময়ের অনুভূতিটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। খুবই কষ্ট পেয়েছি।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যে বয়স হয়েছিল এবং যে রোগ নিয়ে তাকে জীবনযাপন করতে হয়েছে, এমন অবস্থায় আমার পক্ষে যে কাজ করা সম্ভব হবে না, তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। সামান্য জ্বর হলেই আমরা কাতর হয়ে পড়ি। অথচ, তিনি যে শারীরিক অবস্থা নিয়ে কাজ করে গেছেন, তা অবিশ্বাস্য।

ডা. জাফরুল্লাহ স্যারের সঙ্গে আমি প্রায় ২ বছর গভীরভাবে কাজ করেছি। করোনা মহামারির মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেই সময়ে আমি তাকে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। সেই অভিজ্ঞতা বেশ চমকপ্রদ। সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ল্যাবে গবেষণা করছি। অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কিট নিয়ে গবেষণা করে সফল হয়েছি। তখন রমজান মাস। ঈদের ঠিক আগের বা পরের কথা। সব বিজ্ঞানীরা ছুটিতে। আমি ও আমার সহযোগী সাগর কাজ করছিলাম সাভারে গণস্বাস্থ্যের ল্যাবরেটরিতে। হঠাৎ ঢাকা থেকে মোবাইলে কল করে জাফরুল্লাহ স্যার আমাকে বললেন, 'বিজন, আমার জ্বর এসেছে'। তাকে করোনার লক্ষণ জানিয়ে সেগুলো আছে কি না জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, 'হ্যাঁ, এগুলো আছে মনে হচ্ছে।' তখন তাকে বললাম নমুনা পাঠিয়ে দিতে।

রাস্তা খালি থাকায় ৪৫ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা থেকে নমুনা পৌঁছে গেল সাভারে। আমাদের উদ্ভাবিত অ্যান্টিজেন কিট দিয়ে প্রথমবার পরীক্ষা করেই দেখলাম, তিনি করোনা পজিটিভ। এরপরে তার নমুনা আমি আরও ৪ বার পরীক্ষা করেছি। আমাদের কাছে তখন অনেক ভিআইপিদের নমুনা আসত পরীক্ষার জন্য। সেগুলো আমরা ৩ বার পরীক্ষা করতাম। কিন্তু স্যারেরটা পরীক্ষা করেছি ৫ বার। প্রতিবার পরীক্ষাতেই একই ফলাফল এসেছে।

পরীক্ষার ফলাফল হাতে নিয়ে আমি কী বলব, কী করব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তার যে নাজুক শারীরিক অবস্থা, তার মধ্যে করোনা। তখন আমি কল করলাম মঞ্জু ভাইকে (ড. মহিবুল্লাহ খন্দকার মঞ্জু)। তিনি বললেন, 'কাউকে এটা এখনই জানানোর দরকার নাই। আমি দেখছি কী করা যায়।'

আমি আমার ফোন বন্ধ করে দিলাম। কারণ, নমুনা পরীক্ষার ফলাফল জানতে জাফরুল্লাহ স্যার যে আমাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন করবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তাকে কী বলব? করোনা হয়েছে, এখন কী হতে পারে… ভাবতে পারছিলাম না।

রাতে ল্যাব থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ডা. জাফরুল্লাহ স্যারের শারীরিক অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম ভেঙে যায়। টেলিভিশনে দেখি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর করোনা আক্রান্তের খবর আমার রেফারেন্স দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। তখন আমি ডা. জাফরুল্লাহকে ফোন করি।

ফোন ধরেই জিজ্ঞাসা করলেন, 'বিজন, কী ব্যাপার! তোমার মোবাইল কোথায়?'

বললাম, 'চার্জ নেই।'

তিনি বললেন, 'চার্জ নেই, নাকি আমাকে সরাসরি বলতে চাও না। তুমি কি মনে করছো, আমি কোভিডে মরে যাব?'

আমার উত্তর, 'ঠিক তা নয়…'

'শোনো, আমি কোভিডে মরব না। তোমরা ঠিকমতো কাজ করে যাও,' বললেন তিনি।

ওই সময়ে কারও কোভিড হওয়ার মানেই তিনি যেন মৃত্যুর ছায়া দেখতে পেতেন। অথচ, তার মনোবল একটুও টলেনি। যার কিডনি সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, বয়স এত বেশি হয়ে গেছে—সবকিছুর পরও কোভিডকে তিনি এমনভাবে উড়িয়ে দিলেন, আমি আর কথা বলতে পারলাম না। আমি শুধু বললাম, 'সাবধানে থাকবেন।'

দেশ-বিদেশে বহু মানুষ দেখেছি। ডা. জাফরুল্লাহর এই যে মানসিক শক্তি, এটা খুব কম মানুষের মধ্যে আমি দেখেছি। অনেক তরুণকে দেখেছি, কোভিড হয়ে ভয়েই মারা গেছেন। অথচ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেমন লড়াকু ছিলেন।

আরও অনেক কাজে তার সাহস আমরা দেখেছি। আমরা যখন অ্যান্টিজেন কিট তৈরির ঘোষণা দিলাম, তখন সবাই এর বিরোধিতা করেছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, এই কিট দিয়ে পরীক্ষা ঠিক হতে পারে না, এই পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হবে না।

ডা. জাফরুল্লাহ আমাকে বলেছিলেন, 'বিজন, তোমরা কী তোমাদের কিটের বিষয়ে শতভাগ কনফিডেন্ট?'

আমি বলেছি, '১০০ ভাগ কনফিডেন্ট।'

আমার উত্তর শুনে স্যার বলেছেন, 'তাহলে আর কোনো ভয় পেও না। এটা একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই। তুমি বিষয়টি যেহেতু জানো, নিজের মতো কাজ করে যাও। পয়সা নিয়ে কখনো ভাববে না। যেকোনো বিষয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলবে।'

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি খুবই বিরল। আমি সবসময়ই বলি, গবেষকদের স্বাধীনতা না দিলে কিছু করা সম্ভব হয় না। আমাকে ওই সময়ে অনেকে বলেছেন, আপনি আমাদের কাছে না এসে গণস্বাস্থ্যে কেন গেলেন?

আমি বলতাম, ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে এসে বাংলাদেশে মেডিকেল রিসার্চ কর্তৃক আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিলাম, তখন সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেছিলেন যে এই ছেলেটাকে ব্যবহার করেন। তখন কেউ এগিয়ে আসেননি, একমাত্র ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছাড়া। তিনি সুযোগ দিয়েছেন বলেই আমি কাজ করতে পেরেছি। এখন ভালো কাজ করছি বলে আপনারা বলছেন, কেন আপনাদের কাছে যাইনি।

কাজ করার ও কাজকে বোঝার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। মাঝে মাঝে একটু এদিক-সেদিক করে কিছু বললে তিনি ঠিকই ধরে ফেলতে পারতেন। বলতেন, 'ঠিক বলছো কি না, আবার বলো।' এটা সবার মধ্যে থাকে না।

আমরা গবেষণা করে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কিট উদ্ভাবন করলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইমোশনালি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই কিট বাজারে আনা গেল না—এটা নিয়ে তিনি বিক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু খুব যে কষ্ট, দুঃখ পেয়েছেন, তা বলা যাবে না। তিনি আমাদের সবসময় বলতেন, 'দেখো বিজন, গণস্বাস্থ্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সচেতন করা। প্রত্যেকটা মানুষকে তো স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারব না। কিন্তু, সবাইকে যদি সচেতন করা যায়, তাহলে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা কম হবে।'

অ্যান্টিজেন কিটের বিষয়ে তিনি বলতেন, 'আমরা এই কিট তৈরি করে মানুষকে জানাতে পেরেছি, সচেতন করতে পেরেছি। আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছি বলেই সারা পৃথিবীর মানুষ অ্যান্টিজেন কিটের পরীক্ষার সুফল পাচ্ছে। আমরা যদি শুরু না করতাম, তাহলে হয়তো কেউই এটা নিয়ে কাজ করত না। এটা ১০০ কোটি টাকা ব্যবসা করার চেয়েও বড় সফলতা। কারণ, গণস্বাস্থ্য আর্থিক লাভ করার প্রতিষ্ঠান না।'

বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটা বড় গ্যাপ ছিল। কারণ, এত মানুষকে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে এত দ্রুত পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু, অ্যান্টিজেন পরীক্ষা ছড়িয়ে যাবে মানুষের ঘরে ঘরে, যেমনটা মানুষ করে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষার জন্য। এই অ্যান্টিজেন পরীক্ষার বিরুদ্ধে শক্ত বিরোধিতা থাকলেও ডা. জাফরুল্লাহ কিন্তু আমাদের পাশে ছিলেন এবং শক্ত মনোবল দেখিয়েছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৯২ বা ১৯৯৩ সালের দিকে। গণস্বাস্থ্যের একটি ভ্যাকসিন ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ছিল। ভ্যাকসিনের প্রতি আগ্রহ থাকায় বিদেশ থেকে এসে সেখানে আমি গিয়েছিলাম। যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন তিনি এবং কাশেম সাহেব (ডা. আবুল কাশেম চৌধুরী)। সাক্ষাৎকার শেষে আমরাকে জয়েন করতে বলা হয়। কিন্তু, আমাকে সরকার পিএইচডি করতে পাঠানোর কারণে কিছু বাধ্যবাধকতা ছিল এবং শেষ পর্যন্ত আর তখন জয়েন করতে পারিনি। ওই সাক্ষাৎকারেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা।

এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তার সঙ্গে আবার দেখা হলো। তিনি আমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন। আমাকে বললেন, 'তুমি এতদিন পর এসেছ?' ২৮ বছরেও তিনি আমাকে ভোলেননি।

এমন একজন মানুষের গড়া প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর যে স্বপ্ন ছিল, তার অধিকাংশই তিনি বাস্তবায়ন করে গেছেন। একটি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া খুব সহজ বিষয় নয়।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের যে ভূমিকা, সেটা অবাক করার মতো। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ সেখানে কাজ করছেন। আমি তো খুবই অবাক হয়েছি। এত মানুষ এখানে কাজ করছে, অথচ আমরা জানি না।

তিনি প্রতিটি ভালো কাজে সম্পৃক্ত থেকেছেন। সর্বশেষ বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শুনে সেখানেও গিয়েছেন। একটা মানুষ দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য সারাটা জীবন নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন। এমন মানুষ এ দেশে আর কোনোদিন জন্ম নেবে কি না, জানি না।

অনেক মানুষ তাকে নিয়ে অনেক কথা বলেন। কিন্তু, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, পারলে একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হয়ে দেখান, তার মতো কাজ করে দেখান। পারলে তার মতো করে নিঃস্বার্থভাবে নিজের জীবন দেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করে দেখান।

মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত। আমরা কেউই অমর নই। সেই ধারাতেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তার কাজের ধারা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। এই ধারা অব্যাহত রাখা না গেলে তার আত্মা কষ্ট পাবে। আমরা যদি চাই, তিনি ওপারে ভালো থাকুন, তাহলে তার প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে হবে তার দেখানো পথেই। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে এর বিভিন্ন সংস্থা—সঠিক নেতৃত্ব থাকতে হবে প্রতিটি জায়গাতেই। গণস্বাস্থ্যের প্রতিটি কর্মীর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, এই নেতৃত্ব যেন সঠিকভাবে তৈরি হয়।

সরকার ও বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে আমার অনুরোধ, গণস্বাস্থ্য যেন মানুষের সেবায় এগিয়ে চলতে পারে, সে বিষয়ে সহযোগিতা করুন।

ড. বিজন কুমার শীল: অণুজীব বিজ্ঞানী, সার্স ভাইরাসের কিট উদ্ভাবক, করোনাভাইরাস শনাক্তের 'জি র‍্যাপিড ডট ব্লট' কিট উদ্ভাবক

Comments