মাদ্রাসাশিক্ষার্থী বালক যেভাবে হয়ে উঠলেন চলচ্চিত্রকার
কাকরাইল মাদ্রাসার গারদের মতো জানালা দিয়ে মাদ্রাসাশিক্ষার্থী বালক তারেক দেখছে রমনা পার্কে শিশুদের ছোটাছুটি। বিরস বদনে চেয়ে থাকা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। নিষিদ্ধতার বেড়াজালে বন্দি ছাত্রজীবন। খেলাধুলা তো দূরহস্ত, মাদ্রাসা ছেড়ে বের হওয়াই বারণ।
তারেকের মন পড়ে থাকে ফরিদপুরের ভাঙার নূরপুর গ্রামে। শেষবার ভর দুপুরে মাকে ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। দুপুর বেলায় ভাঙা থেকে কাঠের লঞ্চে চেপে টেকেরহাট হয়ে সন্ধ্যায় মাদারীপুর পৌঁছানো। মাদারীপুর থেকে ছাড়ে ঢাকার লঞ্চ। সে লঞ্চ সদরঘাট পৌঁছায় ভোরবেলায়। সেখান থেকে সোজা কাকরাইল মসজিদ মাদ্রাসা।
কয়েক মাস পর পর ছুটিতে বাড়ি যাওয়া। দুই ঈদে দুবার, পরীক্ষা শেষে একবার। এই চলছিল। বাবা যখন তাবলীগে যায় তখন কাকরাইল হয়ে যায় বলেই বাবার সঙ্গে দেখা হয়। কারণ কাকরাইলই তো তাবলীগের সদর দপ্তর। এমন বন্দিদশা ভালো লাগে না তারেকের। একদিন তারেক চাচার সঙ্গে মাদ্রাসা ছেড়ে বাড়িতে চলে যায়। বাবা তখন তাবলীগের ৪০ দিনের সফরে। তারেকের বাবা মশিউর রহমান সফর শেষে কাকরাইল মসজিদে এসে শুনলেন চাচার সঙ্গে নূরপুর চলে গেছে তারেক। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বাড়ি ফিরলেন মশিউর রহমান। ছেলেকে আবার ঢাকা এনে ভর্তি করালেন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী লালবাগ মাদ্রাসায়।
লালবাগ মাদ্রাসায় আরও কঠোর অনুশাসন এবং কড়া নিয়মতান্ত্রিক জীবনে। ফজরের এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে পড়তে হয়। প্রতি বেলায় খাবারের আগে রান্নাঘরে যেতে দেরি করলে খাবার জুটবে না।
একদিন গোসল ও কাপড় কাচতে গিয়ে প্রায় ২০ মিনিট দেরি হয়ে যায় তারেকের। সেদিন আর খাবার জুটেনি। খাবার ঘরের দেয়ালে উর্দুতে তার নামে নোটিশ টাঙ্গানো, 'খানা বান্দ কেয়া গেয়া', অর্থাৎ আজ এই ছাত্রের জন্য খাবার নেই।
একদিনের কথা। মাদারীপুর লঞ্চঘাটে নোঙর করে আছে ঢাকাগামী লঞ্চ। ছেড়ে যাবে কিছুক্ষণ পরই। রাতের খাবারের জন্য কিছু জিনিস কিনতে লঞ্চ থেকে নিচে নেমেছেন তারেকের বাবা মশিউর। এর কিছুক্ষণ পরেই কালবৈশাখীর তাণ্ডব শুরু হলো। লঞ্চটা দুদিকে দুলতে শুরু করল। যেন এখনি ডুবে যাবে। বাবার ফেরারও নাম নেই। নোঙর ছিঁড়ে লঞ্চ মাঝ পদ্মায় চলে গেল।
ডেকের একপাশে বসে ভীষণ ভয়ে কাঁদতে লাগল তারেক। চারপাশে তখন প্রাণের ভয়ে মানুষ কান্নাকাটি, দোয়াদরুদ পড়া শুরু করে দিয়েছে। লঞ্চটা কি তবে ডুবে যাবে মাঝ নদীর তীব্র স্রোতে। রাত তিনটার দিকে থামল ঝড়। কিন্তু সারেং জানেন না লঞ্চ কোথায় আছে। জানেন না কোথায় নোঙর করবে সেই লঞ্চ। একবার বলছে চাঁদপুর, আবার বলছে সদরঘাটেও ভিড়তে পারে। বাবাকে হারিয়ে তারেক তখন ভাবছে সে কি করবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য পরদিন সকালে সেই লঞ্চ এসে ভিড়ল ফের মাদারীপুরেই। মশিউর ততক্ষণে ছেলের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি সন্ধ্যায় খাবার কিনে এসে দেখলেন লঞ্চ নেই। জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকা লঞ্চ হঠাৎই হাওয়া হয়ে গেল। ঘাটে থাকা বাকি লোকদের তিনি যখন জিজ্ঞাসা করলেন এখানে লঞ্চ ছিল না, ওটা কোথায় গেল? ঘাটে থাকা খালাসিরা বললেন ওই লঞ্চ তো ডুবে গেছে অনেক আগেই। এটা শুনে ঘাটেই কান্নায় ভেঙে পড়ে আজান দিতে শুরু করেন মশিউর।
বাবা যখন দেশের বাইরে তাবলীগের সফরে যেতেন তখন মাদ্রাসা থেকে বাড়ি পালাত তারেক। কারণ বাড়িতে অবাধ স্বাধীনতা তার। সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়ানো, গুলতি দিয়ে পাখি শিকার। ভর দুপুরের ফড়িঙয়ের পিছনে সুতা ঝুলিয়ে সারাদিন ছোটা। গ্রামে হাটের দিন চাচার হাত ধরে গোটা হাট চষে বেড়ানো। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন সইল না। তাবলীগের সফর শেষে আবার মশিউর ছেলেকে দেখতে লালবাগ মাদ্রাসায় গেলেন। গিয়ে শুনেন ছেলে বাড়িতে পালিয়েছে ফের। এবারও সেই নাটের গুরু চাচাই। এভাবে তো আর চলে না, ভাবলেন মশিউর। এভাবে ছেলের পড়াশোনা চলবে কি করে। তাকে ফি বছরে চিল্লার সফরে যেতে হবে আর তার অনুপস্থিতির সুবাদে ছেলে পালাবে, পড়াশোনা সব যে শেষ হয়ে গেল।
এ হতে পারে না। শেষমেশ তিনি বাধ্য হয়ে ফন্দি আঁটলেন। চাচা যেন তাকে না খুঁজে পান তাই একদিন তারেককে নিয়ে চাচাদের অগোচরে চলে গেলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারির মধুমতী নদীর তীরে প্রত্যন্ত বাহিরদিয়া গ্রামে। সেই গ্রামেরই এক মাদ্রাসায় ভর্তি করালেন ছেলেকে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তারেক ফিরে এলেন বাড়িতে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ছেলের গোঁ দেখে শেষমেশ ভাঙা পাইলট হাইস্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হলেন মশিউর। সেই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তারেক। পড়াশোনায় মনোযোগ থেকে তারেককে গেণ্ডারিয়ার নিজের বাসায় নিয়ে এলেন চাচা। উচ্চ মাধ্যমিকে তাকে ভর্তি করানো হলো আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। সেখানে বহু বন্ধু জুটেছিল। পরবর্তীতে নটরডেম কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়ার সুযোগ পেলেন তারেক। স্নাতকে পড়া অবস্থায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যোগ দিলেন তারেক। একই সঙ্গে লেখক শিবির, বাম আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তাকে বেশিরভাগ সময়েই দেখা যেত ঢাকা আর্ট কলেজে। চলচ্চিত্র আন্দোলনের মাধ্যমে তারেক মাসুদের সঙ্গে পরিচয় হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, শামীম আখতারদের সঙ্গে। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
এক পর্যায়ে তিনি ভাবলেন তার তো কিছু করা চাই। ১৯৮২ সালের একদিনের কথা। সদ্য বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করেছেন তারেক। পরিকল্পনা উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন মুলুকে গমন। টাকা পয়সার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। এর আগে কাগজপত্রের ঝামেলায় যাওয়া হয়নি ভারতের পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে।
তাই এবার কোমর বেঁধে নামা। হঠাৎ একদিন শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর আহমদ ছফার একটি লেখা নজরে এলো তারেকের। মুগ্ধ হয়ে পড়লেন। সুলতানের জীবন তাকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করল।
আহমদ ছফার সঙ্গে দেখা করলেন তারেক। ঠিক করলেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে তার প্রথম কাজই হবে শিল্পী এসএম সুলতানের ওপর। কিন্তু ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন তাকে বললেন, 'এই কাজটিই কর। সুলতান কদিন বাঁচবে ঠিক নেই। তুমি কাজ শুরু করে দাও। আমেরিকা তো পরেও যেতে পারবে।' শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে জমানো ও সংগৃহীত সমস্ত অর্থ দিয়ে সুলতানের ওপর 'আদম সুরত' তথ্যচিত্রের কাজ করেছিলেন তারেক। জীবনের প্রথম প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে আর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা হয়ে ওঠেনি তারেক মাসুদের।
ছোটবেলা থেকেই শহর ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত তারেক মাসুদকে। তিনি বলতেন, 'আমি গ্রামের ছেলে বলেই হতো শহরটাকে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো। শহরকে মনে হতো আড়ং বা মেলা। সুলতানকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে গিয়ে গ্রামকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম।' সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র করতে গিয়ে সুলতানের চোখেই নতুন করে গ্রাম বাংলাকে অবলোকন করেছিলেন তারেক মাসুদ। আদম সুরত নির্মাণ করতে তার সময় লেগেছিল প্রায় সাত বছর। অর্থাভাবে কখনো কাজ চলে তো, ফের বন্ধ হয়ে। ১৯৮২ সালে শুরু হওয়া আদম সুরত শেষ অবধি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
নিজের শৈশব কৈশোরের মাদ্রাসার অবরুদ্ধ সময়ের গল্প তারেক মাসুদ ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না'র 'আনু' চরিত্রের মধ্য দিয়ে। যে চলচ্চিত্রের জন্য ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট' পুরস্কার পেয়েছিলেন তারেক মাসুদ। বলাবাহুল্য মাদ্রাসা পড়ুয়া তারেকের চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ হয়ে ওঠার পথটি কখনোই মসৃণ ছিল না।
এক যুগ আগে আজকের দিনেই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় চলে গিয়েছিলেন তারেক মাসুদ। তিনি শারীরিকভাবে চলে গেলেও রেখে গেছেন তার অসামান্য সব চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র। যে সৃষ্টিকর্মগুলো তাকে স্মরণীয় করে রাখবে চিরকাল।
প্রয়াণ দিবসে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
Comments