শফী আহমেদ: নিভে গেল রাজনীতির এক স্বাপ্নিক সূর্য

শফী আহমেদ কিংবদন্তী ছাত্রনেতাই ছিলেন। ছিলেন অগ্রগামী চিন্তার এক মানুষ। রাজনীতির ময়দানে এরকম মানুষের সংখ্যা এখন কেবলই কমে আসছে।

সাবেক ছাত্রনেতা শফী আহমেদ—সবার প্রিয় 'শফী ভাই'—আকস্মিকভাবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন গত ৩ জুন। শফী আহমেদের এমন আকস্মিক মৃত্যুতে দেশজুড়ে তার রাজনৈতিক অনুসারী, ভক্ত, শুভানুধ্যায়ীরা যার পর নেই ব্যথিত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন।

তার মৃত্যু সংবাদে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়েছেন অনেকেই। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের ধুলোমাখা আয়নায় ফিরে তার সতীর্থ ও সহযোদ্ধারা অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারেননি।

৩ জুন বিকেলে শফী আহমেদ উত্তরার বাসায় ঘুমের মধ্যেই মারা যান। পরের দিন ৪ জুন শফী আহমেদের মরদেহ যখন জাতীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে কড়ই গাছের নিচে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য রাখা হয়, তখন রাজধানী ঢাকা এবং আরও দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্যজন।

যারা ছুটে আসেন, তারা আর কেউ নন—একদা যারা শফী আহমেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের স্বপ্নে রক্ত শপথে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতেন, যারা একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে জীবন দিতে কুণ্ঠিত বোধ করতেন না, যারা এরশাদের সামরিক শাসনের আমলে জীবনের সবকিছুকে তুচ্ছ করে মিছিলে-আন্দোলনে-সংগ্রামে শামিল হতেন, বেশিরভাগ তারাই ছুটে আসেন।

আশি-নব্বই দশকের মিছিলের ঠিক সেই মুখগুলোরই উপচে পড়া ভিড় ছিল সেদিন। সবারই চোখ-মুখ ছিল ভীষণ ম্রিয়মাণ।

শফী আহমেদ ছিলেন এক স্বাপ্নিক রাজনীতিক, যিনি বৈষম্যহীন ও ন্যায়-ন্যায্যের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। এইতো ২০ এপ্রিল শহীদ মিনারে তিনি জাতীয় পতাকার প্রথম নকশাকার শিব নারায়ণ দাশের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে সেই কথাই উচ্চারণ করছিলেন বারবার। মাত্র কদিনের ব্যবধানে সেই শহীদ মিনারে তিনি এলেন আরেকটি নতুন কফিনে।

কে এই শফী আহমেদ? তার রাজনৈতিক বড় কোনো পদ-পদবী ছিল না। ছিলেন না তিনি এমপি বা অন্যকিছু। ছিলেন আওয়ামী লীগের কোনো এক উপ-কমিটির নামকাওয়াস্তে নগণ্য এক সদস্য।

কিন্তু না, শফী আহমেদের রাজনৈতিক, সামাজিক পরিচয় শুধু আওয়ামী লীগ বৃত্তে কখনই আটকে থাকেনি। এই বৃত্তের বাইরেই বরং তিনি ছিলেন অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি আলোকিত।

৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা শফী আহমেদ জাতীয় রাজনীতিতে বড় কোনো জায়গা করে নিতে না পারলেও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে তার সাহসী ও তেজদীপ্ত ভূমিকা আলোচনায় থেকেছে।

শফী আহমেদ ছিলেন আশির দশকের তুমুল ছাত্র রাজনীতি কালের এক হীরকখণ্ড। সে সময়ই তিনি দ্যুতি ছড়ান শ্রেফ রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতার শক্তি দিয়ে। আর তাই জীবনের শেষ অব্দি বড় পদ-পদবী না পেলেও শফী আহমেদ পুরনোদের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি।

'৮৯ সালে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সে সময় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নাজমুল হক প্রধান। জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (না-শ) নামেই পরিচিত ছিল। সাধারণ সম্পাদকের আগে ছাত্রলীগের তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এর আগে তিনি জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্ব দেন।

আসলে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় শফী আহমেদ তার রাজনৈতিক ক্যারিশমার কারণেই বড় বেশি আলোচিত হয়ে ওঠেন। আশির দশকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হল দখলের রাজনীতি আর পেশীশক্তি প্রদর্শনে মত্ত, তখন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ এক নতুন শক্তি হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে।

একইসঙ্গে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ এবং জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে এক লড়াকু ছাত্র সংগঠন হিসেবে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলে জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সত্যটা হলো শফী আহমেদ সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়ে সর্বমহলে ব্যাপকভাবে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হন। তিনি তখন খ্যাতি পান ছাত্র রাজনীতির 'ম্যাজিকম্যান' হিসেবেও।

বলতে দ্বিধা নেই, এরশাদের পতনের আগে ছাত্র আন্দোলন নিয়ে রাতের আঁধারে বহুবিধ ধুম্রজাল তৈরি হলেও শফী আহমেদ তার অনুসারীদের নিয়ে যেকোনো মূল্যে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করতে ঐক্যবদ্ধ বার্তা দেন। সে সময় অভি-নীরু এরশাদের পক্ষে ক্যাম্পাস দখলের পায়তারা চালালেও শফী আহমেদ জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে সমুচিত জবাব দেন।

এরকম অনেক ঘটনাই শফী আহমেদ বলাকা ভবনে বসে ঠান্ডা মাথায় সামাল দিয়েছেন। কখনও কারো কাছে তিনি বিক্রি হননি। আর এ কারণেই তিনি সব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকেই সমীহ পেয়েছেন।

শফী আহমেদ আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এবং সবশেষে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদের অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পেয়েছিলেন একদল সাহসী চকচকে তরুণ—যারা সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এবং সত্যিই সমাজ পরিবর্তনের লড়াইকে এগিয়ে নিতে বুকের রক্ত দিতে কখনই দ্বিধা করেননি। যারা সব ধরনের অন্যায়-অনিয়মের বিপক্ষে প্রতিবাদে রাজপথে সোচ্চার থেকেছেন।

শফী আহমেদ বরাবরই জাসদ ছাত্রলীগের একঝাঁক সৃজনশীল, ক্ষ্যাাপাটে, সাহসী তরুণদের মধ্যমণি ছিলেন। শুধু রাজনীতি নয়, একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নিতে কবি ও আবৃত্তিকার ইস্তেকবাল হোসেন, প্রয়াত কবি শিমুল মোহাম্মদ, কবি লুৎফুল হোসেন বাবু, আবৃত্তিকার আহকাম উল্লাহর মতো চৌকস তরুণদের নিত্য প্রেরণা যুগিয়ে গেছেন সবসময়।

শফী আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয় মাঝে লালন করতেন। আর  তাই জামাত-শিবিরের হত্যার রাজনীতির দাম্ভিকতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে তিনি সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ছাত্র রাজনীতির সোনালী অধ্যায় শেষে রাজনীতির নানা মেরুকরণের পথ-পরিক্রমায় শফী আহমেদ এক সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। আর সর্বশেষ তিনি জাসদ ছেড়ে যোগ দেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে।

কিন্তু আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও শফী আহমেদের 'জাসদ পরিচিতি' কখনই মুছে যায়নি। আওয়ামী লীগ থেকে তিনি কখনই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। আর তাই মান-অভিমানের পালায় রাজনীতিক হয়েও রাজনীতির ময়দানে জ্বলে উঠতে পারেননি।

শফী আহমেদ বরাবরই রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভীষণ সোচ্চার থেকেছেন। তার মতো সাবেক কোনো ছাত্রনেতাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতোটা সক্রিয় থাকতে দেখা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি চে গুয়েভারা, লেনিন, মুজিব থেকে কর্নেল আবু তাহেরের সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির কথা সবসময় উচ্চারণ করেছেন; সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমামদের জীবন দর্শনের কথা তুলে ধরতেন। নির্বিবাদে লিখতেন একাত্তরের ঘাতক দালালদের অমার্জনীয় অপরাধের কথা। লিখতেন এ দেশের শ্রমজীবী-খেটে খাওয়া মানুষের অধিকারের কথা।

আর দলীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার থেকেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার পরও প্রায় প্রতিদিনই তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ও তাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থাকে ব্যক্তিদের দুর্নীতি, রাষ্ট্রের সম্পদ চুরি, এসব ঘটনাবলীর তীব্র সমালোচনা করতেন।

তার স্ট্যাটাস দেখে অনেকেই শঙ্কিত হতেন। অনেকেই ভাবতেন, আওয়ামী লীগের একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি এসব পোস্ট কীভাবে করেন?

রাজনীতির অনেক অতীত বিষয় তিনি মনে করিয়ে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, মুশতাকের মন্ত্রীসভা, তাহেরের ফাঁসি, জাসদের ভুলচুক, তিনজোটের রূপরেখা, ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা—এসব নিয়ে তিনি প্রায়ই পোস্ট দিতেন।

শফী আহমেদ আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ছাত্রজীবনে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের যে স্বপ্ন লালন করতেন, তা থেকে কখনই বিচ্যুত হয়েছে বলে মনে হয়নি। আর এ কারণেই আপোষহীনভাবেই তিনি সত্য তুলে ধরেছেন।

শুধু এই নয়, শফী আহমেদ প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নীরেন্দ্র চক্রবর্তী থেকে শুরু করে নাজি, হিকমত, নবারুণ ভট্টাচার্য, হুমায়ুন আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ইস্তেকবাল হোসেনের বিপ্লবী সব কবিতা তুলে ধরতেন। শফী আহমেদ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। টক শোতে অংশগ্রহণ করতেন। সেখানে বলতেন তার স্বপ্নের কথা।

জীবনের শেষ অব্দি তিনি দেখেছেন বৈষম্যহীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে। তাই জীবনের শেষ দিনটিতেও তিনি সত্য উচ্চারণ করে গেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা; বাহাত্তরের সংবিধানের কথা; ত্রিশ লাখ শহীদের কথা। রাজনীতির ময়দানে প্রত্যাশিত জায়গা না পেলেও নিজের মুক্ত মতামত দিতে তিনি কখনই ভুল করেননি।

শফী আহমেদের মৃত্যুর পর তার রাজপথের সহযোদ্ধা কবি লুৎফুল হোসেন বাবু ফেসবুকে লিখেছেন, 'হয়তো শুধুই মানুষের জন্য ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো প্রজন্মের আপনিই শেষ জন। আপনার বোনা ফসলেইতো গোলা ভরলো কতজনের। তারা কেউ কী কোনোকালে উচ্চারণ করবে এইসবের একটু কিছু? হয়তো নষ্ট সময়ের নষ্ট আঁচ না লাগতেই আপনি চলে গেলেন জনমানুষের হয়েই অনন্ত জীবনের যাপনে। আপনি হারিয়ে যাননি, হারিয়েছে অভাগা জনমানুষ। আপনার হারায়নি কিছুই, হারিয়েছে এ দেশের রাজনীতি। অবশ্য তার আর অবশিষ্ট আছেই বা কতটুকু।'

এরপর আর কিছুই বলার থাকে না। শফী আহমেদ মারা যাওয়ার পর কবি মোহন রায়হান ফেসবুকে লেখেন, 'সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কিংবদন্তী ছাত্রনেতা শফী আহমেদ আর নেই।'

আসলে শফী আহমেদ কিংবদন্তী ছাত্রনেতাই ছিলেন। ছিলেন অগ্রগামী চিন্তার এক মানুষ। রাজনীতির ময়দানে এরকম মানুষের সংখ্যা এখন কেবলই কমে আসছে। তবে একজন কিংবদন্তী ছাত্রনেতা শফী আহমেদ যে রাজনীতির ভুল জায়গায় পা রেখেছিলেন, তা বললে ভুল হবে না।

জাহিদ রহমান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও গবেষক

Comments

The Daily Star  | English

UK election: Winner Starmer inherits weak economy with 'no magic wand'

Britain's next prime minister Keir Starmer spent the election campaign accusing Rishi Sunak's Conservatives of "14 years of economic failure", but he has no obvious quick fix to lift the country out of its slow-growth rut

27m ago